Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

রাসূলপ্রেমীদের হৃদয়ভূমি মসজিদে নববী

Icon

ড. সৈয়দ এ. এফ. এম. মঞ্জুর-এ-খোদা

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাসূলপ্রেমীদের হৃদয়ভূমি মসজিদে নববী

মসজিদে নববী। মুসলিম উম্মাহর পবিত্রতম আবেগের নাম। এ মসজিদের কথা স্মরণ হতেই রাসূলপ্রেমীদের মনে ভেসে ওঠে সবুজ গম্বুজের মনোরম চিত্র; অজান্তেই মন হু হু করে কেঁদে ওঠে, দুচোখ ভিজে যায়। কেননা এখানেই রয়েছে বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, শাফায়েতের কাণ্ডারী, দোজাহানের বাদশাহ, রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর রওজা শরিফ। রাসূলপ্রেমী প্রত্যেকেই জীবনে অন্তত একবারের জন্য হলেও মসজিদে নববী তথা মদিনা মুনাওয়ারায় যাওয়ার ইচ্ছা অন্তরে পোষণ করেন। এ ইচ্ছাই কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-‘আয় মরু-পারের হাওয়া, নিয়ে যা রে মদিনায়/ জাত পাক মোস্তফার, রওজা মোবারক যেথায়।’

মদিনা নগরীর প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে মসজিদে নববী। এ মসজিদটি সৌদি আরবের পশ্চিম অংশের অন্তর্গত মদিনা শহরে অবস্থিত। এ মসজিদ শুধু নামাজ বা ইবাদতের স্থান হিসাবেই গণ্য হতো না, বরং ইসলামি জ্ঞানচর্চা এবং ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনার মূল কেন্দ্র ছিল মসজিদে নববী। হজরত রাসূল (সা.)-এর সুহবতে থেকে আহলে সুফফার সদস্যরা নিজেদের আলোকিত মানুষরূপে গড়ার সুযোগ পান। পরে তারা সারা বিশ্বে রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত রাসূল (সা.)-এর আদর্শ প্রচারের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।

হজরত রাসূল (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে ১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল (২৪ সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রি.), শুক্রবার মদিনায় পৌঁছানোর মাধ্যমে মসজিদে নববীর ইতিহাস রচিত হয়। তিনি ‘কাসওয়া’ নামক উটনীর পিঠে আরোহণ করে মদিনায় প্রবেশ করার পর আনসারদের বিভিন্ন গোত্রের সবাই তাকে নিজ গৃহে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। প্রত্যেকেই হজরত রাসূল (সা.)কে তাদের দাওয়াত কবুল করার নিবেদন করেছিলেন। হজরত রাসূল (সা.) তাদের আন্তরিক অভ্যর্থনার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার এই উটনী যার গৃহদ্বারে বসবে, আমি সেই গৃহেই অবস্থান করব।’ সবাই উৎসুক হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে থাকা উটনীর গতিবিধি লক্ষ করতে লাগলেন।

অবশেষে উটনীটি নাজ্জার গোত্রের এলাকায় হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়ির পাশে একটি অনাবাদি জমিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তাই আল্লাহর রাসূল (সা.) হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়িতেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলেন। অতঃপর হজরত রাসূল (সা.) সেই অনাবাদি জমিতে নিজ বাসস্থান এবং একটি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। উটনীটি যে জমিতে থেমে যায়, সে জমিটি নাজ্জার গোত্রের সাহল ও সুহাইল নামের দুই এতিম সহোদর বালকের ছিল। যখন তারা জানতে পারল যে, মসজিদ নির্মাণ করার জন্য হজরত রাসূল (সা.) তাদের জমি পছন্দ করেছেন, তখন তারা হজরত রাসূল (সা.)-এর কাছে গিয়ে তাকে জমিটি উপহার দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু হজরত রাসূল (সা.) ন্যায্যমূল্য ১০ দিনার দিয়ে জমিটি ক্রয় করে নেন। ওই স্থানেই হজরত রাসূল (সা.) ‘মসজিদে নববী’ নির্মাণ করেন। আর এ ঐতিহাসিক মসজিদের পাশেই তিনি নিজ বাসস্থান নির্মাণ করেন।

১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল (২৪ সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) হজরত রাসূল (সা.) নিজেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) নিজেই তার পিতা হজরত আবদুল্লাহ্ (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত একটি বর্শা দিয়ে সীমারেখা টেনে মসজিদের সীমানা নির্ধারণ করেন, যার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১১৫ ফুট এবং প্রস্থ ছিল প্রায় ১০০ ফুট। ফলে মসজিদের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ১১ হাজার ৫০০ বর্গফুট। অতঃপর হজরত রাসূল (সা.)-এর নির্দেশক্রমে ওই স্থানের খেজুর গাছগুলো কেটে জমি সমান করা হয়। জমির একদিকে নিচু হওয়ায় প্রথমে নিচু অংশ ভরাট করা হয়। এরপর কিছু পাথর দিয়ে মসজিদের ভিত তৈরি করা হয়। মসজিদ নির্মাণের জন্য মদিনার ‘আল খাবখাবা’ নামক উপত্যকা থেকে কাদামাটি এনে তা রোদে পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হয় এবং সিমেন্ট হিসাবে ওই কাদামাটিই ব্যবহার করা হয়। ইট প্রস্তুত করা হয়েছিল বর্তমান জান্নাতুল বাকির কাছে অবস্থিত মসজিদে ইবরাহিমের উত্তরদিকে। হজরত রাসূল (সা.) নিজে ইট তৈরিতে সাহাবিদের সাহায্য করেছেন। এরপর প্রথমেই মসজিদের সীমানা দেওয়াল নির্মাণ করা হয়। ৪.৫ ফুট গভীর গর্ত খনন করে ভেতরের অংশে পাথর ও ওপরের অংশ রোদে পোড়ানো কাঁচা ইট দিয়ে দেওয়ালের ভিতটি তৈরি করা হয়। নির্মাণকার্যে হজরত রাসূল (সা.) নিজেই অংশগ্রহণ করেন এবং ইট-পাথর বহন করার সময় সাহাবায়ে কেরামকে উৎসাহ প্রদানের জন্য কবিতার ছন্দে বলেন, ‘খায়বরের সুস্বাদু খেজুর ও সুস্বাদু আঙুরের বোঝা বহন করা অপেক্ষা এ ইটের বোঝা বহন করা অধিকতর প্রীতিকর। হে আমাদের প্রভু! ইহাই তোমার নিকট পুণ্যতম ও পবিত্রতম।’ (বোখারি শরিফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭১, ৫৫৫)। হজরত রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে সাহাবিরাও সমবেত কণ্ঠে কবিতাটি আবৃত্তি করতেন।

মসজিদে নববী নির্মাণকালে মুসলমানদের কেবলা ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস। তাই মসজিদে নববীর কেবলা ছিল উত্তর দিকে অর্থাৎ বায়তুল মোকাদ্দাসমুখী। কেবলা নির্দেশক হিসাবে দেওয়ালের গায়ে একটি পাথর স্থাপন করা হয়। মসজিদটির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মক্কা থেকে আগত মুহাজির সাহাবিদের জন্য খেজুর পাতার ছাউনি দিয়ে একটি বারান্দা নির্মাণ করা হয়। এ স্থানটিকে বলা হয় ‘আল সুফফাহ’। আরবি ‘সুফফাহ’ শব্দের বাংলা অর্থ বারান্দা। এ স্থানে যেসব সাহাবি বসবাস করতেন তাদের আহলে সুফফাহ হিসাবে অভিহিত করা হয়। আবু নাঈম রচিত ‘আল হেলইয়া’ গ্রন্থে তাদের সংখ্যা ১০০-এরও অধিক বলে উল্লেখ রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমি ৭০ জন সুফফা বাসিন্দাকে দেখেছি।’ (ওয়াফাহ আল ওয়াফাহ, ২য় খণ্ড; নূরুদ্দিন সামহুদী)।

মসজিদে নববীতে প্রবেশের জন্য সেসময় ৩টি দরজা ছিল। এগুলো হলো-দক্ষিণ দিকের দরজা : এটি ছিল মসজিদে নববীর প্রধান প্রবেশ পথ। এ দরজা দিয়ে সাধারণ মুসল্লিরা মসজিদে প্রবেশ করত এবং বের হতো। পশ্চিম দিকের দরজা : এ দরজাটির নাম ছিল ‘বাবে রহমত’ বা ‘বাব আল আতিক’। পূর্ব দিকের দরজা : এ দরজাটির নাম ছিল ‘বাব আল জিব্রাইল’। এ দরজা দিয়েই হজরত রাসূল (সা.) মসজিদে নববীতে প্রবেশ করতেন বিধায় একে ‘বাব উন নবি’ও বলা হয়।

রোদের তাপের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে উত্তরমুখী করে মসজিদের ছাদ নির্মাণ করা হয়। ছাদটি খেজুরগাছের কাণ্ডের স্তম্ভের ওপর খেজুর পাতার ছাউনির সঙ্গে কাদামাটির প্রলেপ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। বৃষ্টির পানি নামার জন্য ছাদটি কিছুটা ঢালু করে তৈরি করা হয়। প্রত্যেকটি সারিতে ১৮টি করে দুই সারিতে ৩৬টি স্তম্ভ ছিল। ছাদটি প্রথম ২১ ফুট উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়। এ সম্পর্কে হজরত রাসূল (সা.) বলেন, ‘মসজিদের ছাদ মুসা (আ.)-এর ছাদের অনুরূপ ৭ গজ (২১ ফুট) উঁচু করে তৈরি কর।’

ওজুর সুবিধার্থে মসজিদের বাইরে একটি কূপ স্থাপন করা হয়। এভাবে দীর্ঘ ৭ মাস কাজ করার পর ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগে মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়।

মসজিদে নববীর প্রথম পর্যায়ে আজানের প্রচলন ছিল না। পরবর্তী সময়ে খাজরাজ গোত্রের হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ ইবনে আবদে রাব্বি (রা.)কে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নযোগে সবুজ পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তির দ্বারা আজানের বাক্যগুলো বলে দেওয়া হয়। হজরত উমর (রা.)ও স্বপ্নের মাধ্যমে আজানের বাক্যগুলো জানতে পারেন। এরপর হজরত রাসূল (সা.) আজানের মাধ্যমে নামাজের আহ্বান জানানোর নির্দেশ দেন। তৎকালীন মসজিদে কোনো মিনার না থাকায় হজরত রাসূল (সা.) মসজিদসংলগ্ন একটি উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে হজরত বিলাল (রা.)কে আজান দেওয়ার নির্দেশ দেন, যেন দূর থেকে আজানের ধ্বনি শোনা যায়। পরে মসজিদের পূর্ব পাশে অবস্থিত হজরত হাফসা (রা.)-এর ঘরের পাশে একটি ছোট স্থানে দাঁড়িয়ে হজরত বিলাল (রা.) আজান দিতেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম