কারবালার কান্না শোনা যায় হোসনি দালানে
নূর আহমাদ
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
তিরমিজি শরিফ বাবে মানাকিবের হাদিস থেকে জানা যায়, কারবালায় ইমাম হোসাইনকে শহীদ করার সময় দয়াল নবীজী (সা.) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হাদিসটি এ রকম-সালমা (আল-বাকরিয়া) (রহ.) বলেন, একবার আমি উম্মে সালামা (রা.) গিয়ে দেখি তিনি কাঁদছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওগো উম্মুল মুমিমিন! আপনি কাঁদছেন কেন? উম্মে সালামা বললেন, ‘আমি রাসূলকে স্বপ্নে দেখেছি। তার চেহারায় ও দাড়িতে ধুলা, গায়ে মাটি।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনার এ রকম হলো কেন? উত্তরে তিনি বললেন, ওগো উম্মে সালামা! ওরা আমার হোসাইনকে কতল করে ফেলেছে। আমি এই মাত্র হোসাইনের কাছ থেকে এসেছি।’
বর্তমান হিসাবে মদিনা থেকে কারবালার দূরত্ব প্রায় এক হাজার ৩৫০ কিলোমিটার। এত বিশাল দূর থেকে কারবালার নির্মম ঘটনা শুনে সেদিন কেঁদেছিলেন উম্মে সালামা (রা.)। আর ইমাম পরিবারে নারী সদস্যদের কান্নার কথা কী বলব? প্রাণপ্রিয় ভাই হোসাইনের মৃতদেহ একদিকে পড়ে আছে। আর মাথা বর্শায় গেঁথে ইবনে জিয়াদ বুনো উল্লাসে এগিয়ে চলছে ইয়াজিদের দরবারে। বর্শায় গাঁথা ভাইয়ের মাথা দেখে কোন বোন নিজেকে ধরে রাখতে পারে। এতো গেল দুনিয়ায় হোসাইনের আপনজনদের কান্নার খণ্ড চিত্র। আসমানে কী হয়েছে তার একটি চিত্র পাওয়া যায় জাতীয় কবি নজরুলের মহররম কবিতায়-
নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,-
‘আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া!’
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে!
বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, ইমাম হোসাইনের শাহাদতের সময় নবীজী, মাওলা আলী, মা ফাতেমা ও হজরত হাসান হাজির হয়েছিলেন ব্যাথাতুর হৃদয় নিয়ে। হোসাইনের গলায় ছুরি চালানোর দৃশ্য দেখে কেঁদেছিলেন আসমান-জমিনের সব ফেরেশতাও। বুজুর্গদের কাশফ ও স্বপ্ন হয়ে এসব বর্ণনায় দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে জনে জনে। উম্মে সালামা (রা.) থেকে শুরু হয়েছে হোসাইনের জন্য কান্না। এরপর যতই সময় গড়িয়েছে কান্নার পরিধি বেড়েছে। সংখ্যা বেড়েছে। প্রেমিক বেড়েছে।
বলা হয়, কান্না প্রেমের ভাষা। প্রেমাষ্পদকে দূরে রেখে যে প্রেমিকের চোখে পানি আসে না সে আসলে প্রেমিকই না। প্রেমিকের কষ্ট দেখে যার হৃদয় ভেজে না সে তো প্রতারক। যুগে যুগে তাই হোসাইন প্রেমিকরা কান্নাকেই বেছে নিয়েছেন প্রেম প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে। যেখানেই হোসাইন প্রেমিক সেখানেই কান্নার মেলা বসেছে। সে মেলায় শোনা যায় কারবালার করুণ সুর। তেমনই এক মেলা বসেছে পুরান ঢাকার হোসনি দালানে। মহররমের দিনগুলোতে কান্নায় ভেজা থাকে দালানের ইট-সুরকি।
শিয়া-সুন্নি ভেদাভেদ ভুলে, ধর্মের প্রাচীর ডিঙিয়ে সব মত-পথের সত্য প্রেমিকরা এসে ভিড় জমায় এখানে। দেড় হাজার বছর আগে উম্মে সালামা আর মা ফাতেমার কান্নার সুরের সঙ্গে সাদৃশ্য করার এক প্রতীকী আয়োজন এ প্রেমের কান্না।
হোসাইন প্রেমিকরা এখানে শুধু চোখের পানি ফেলেন না, হৃদয়ের রক্তও ঢেলে দেন প্রেমের নজরানা হিসাবে। মহররমের ১০ দিন মাতম আর বুকফাটা আর্তনাদে হোসনি দালান পরিণত হয় এক শোকমঞ্চে, যেখানে প্রতিটি ধ্বনি, প্রতিটি অশ্রু থেকে উচ্চারিত হয়-হায় হোসেন! হায় হোসেন! এ কান্না শুধু শোক নয়। এটা প্রতিবাদেরও ভাষা। অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস, অন্যায়ের সামনে মাথা না নোয়ানোর দৃঢ় সংকল্প। হোসাইন প্রেমিকরা শুধু তার ত্যাগের গল্পই স্মরণ করে না, তার আদর্শও ধারণ করে।
হোসাইনি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ ফারহান হোসেন বলেন, প্রতি বছর আশুরার দিনে হোসনি দালানে যারা জড়ো হন তারা জানেন, হোসাইন কেবল অতীত ইতিহাস নয়, তিনি এ সময়েরও প্রেরণা। যেখানে অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সত্য চাপা পড়ে শক্তির কাছে, সেখানেই হোসাইনের রক্ত প্রতিবাদের স্বরে গর্জে ওঠে। আমাদের এ কান্না হোসাইনের সত্যের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার অঙ্গীকার। হোসনি দালানের বাতাসে সে অঙ্গীকার ছড়িয়ে পড়ে জুলুমের বিরুদ্ধে কালবৈশাখী ঝড় হয়ে। কারবালার কান্না জারি রয়েছে উম্মে সালামার চোখ থেকে ঢাকার হোসনি দালান পর্যন্ত। এ কান্না এক পবিত্র উত্তরাধিকার, যা প্রতিটি হোসাইন প্রেমিকের হৃদয়ে লালন করে প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে। হোসনি দালান বা ইমামবাড়া কেবল একটি ইমারত নয়; এটি একটি বিশ্বাস, একটি শতাব্দী প্রাচীন শোকের মাতম এবং কারবালার সেই রক্তাক্ত প্রান্তরের এক টুকরো জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, যা পুরান ঢাকার হৃদয়ে সযত্নে লালিত হয়ে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এর অস্তিত্ব শুধু ইট-পাথরের কাঠামোতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মিশে আছে এ শহরের বাতাসে, মানুষের বিশ্বাসে আর অগণিত চোখের জলে।’
হোসনি দালানের ইতিহাস এক অলৌকিকতা ও গভীর ভক্তির মোড়কে ঢাকা। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, যখন বাংলার মসনদে আসীন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা, তখন তার নৌ-সেনাপতি সৈয়দ মীর মুরাদ এ পবিত্র ইমারতটি নির্মাণ করেন। লোকমুখে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, মীর মুরাদ ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ। এক গভীর রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন, কারবালার প্রান্তরে শাহাদতবরণকারী স্বয়ং ইমাম হোসাইন নিজেই তাকে ‘তাজিয়াখানা’ বা শোক প্রকাশের গৃহ নির্মাণের নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই আধ্যাত্মিক ও ভাবগম্ভীর স্বপ্নের মাধ্যমে তিনি এতটাই অনুপ্রাণিত ও আলোড়িত হন যে, কালবিলম্ব না করে এ ইমামবাড়া নির্মাণে ব্রতী হন। সেই স্বপ্নজাত ইমারতই কালক্রমে ‘হোসনি দালান’ নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে। শুরুতে এটি হয়তো একটি সাদামাটা স্থাপনা ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কলেবর, স্থাপত্যশৈলী এবং গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে, ১৮৯৭ সালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে ভবনটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ঢাকার তৎকালীন নবাব খাজা আহসানউল্লাহ এর সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের মহান দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একে বর্তমানের এই নয়নাভিরাম রূপ দান করেন।
স্থাপত্যশিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে হোসনি দালান মুঘলরীতির এক অনন্য নিদর্শন। এর প্রধান আকর্ষণ হলো বিশাল চত্বরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত মূল শ্বেতশুভ্র ভবন এবং তার সামনে থাকা মনোরম দিঘি। এ দিঘিটি কেবল সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নির্মিত জলাশয় নয়, এর রয়েছে এক গভীর এবং মর্মস্পর্শী প্রতীকী তাৎপর্য। কারবালার উত্তপ্ত মরুপ্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.), তার পরিবার ও সঙ্গীদের যেভাবে ফোরাত নদীর পানি থেকে নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল, এ দিঘিটি যেন সেই তৃষ্ণার্ত স্মৃতিরই এক করুণ প্রতিচ্ছবি। দিঘির শান্ত, স্থির পানিতে যখন ইমামবাড়ার অপূর্ব স্থাপত্যের ছায়া পড়ে, তখন দর্শনার্থীর মনেও অজান্তে কারবালার সেই বিষাদময় দিনের ছায়া নেমে আসে।
মূল ভবনটির সাদা দেওয়ালের ওপর নীল রঙের সূক্ষ্ম কারুকাজ এক ধরনের পবিত্র ও শান্তিদায়ক আবহ তৈরি করে, যা স্থানটির ভাবগাম্ভীর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ভবনের ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে এক সুবিশাল হলঘর, যেখানে মহররমের মাসজুড়ে শোকসভা, বয়ান ও মাতম অনুষ্ঠিত হয়। এর দেওয়ালজুড়ে পবিত্র কুআনের আয়াত, ফার্সি ভাষায় খোদাই করা ক্যালিগ্রাফি এবং কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার চিত্রশিল্প স্থান পেয়েছে, যা এখানকার পরিবেশকে আরও শোকাবহ ও আধ্যাত্মিক করে তোলে।
মহররম মাসের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পুরো হোসনি দালান এলাকাটি যেন এক শোকের ময়দানে পরিণত হয়। কালো পতাকা, কালো পোশাক, আর লক্ষ কণ্ঠের ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ ধ্বনিতে ভারী হয়ে ওঠে ঢাকার আকাশ-বাতাস। এটি শুধু শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং ঢাকার ৪০০ বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে ওঠে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ এ শোকের মিছিলে ও মাতমে অংশ নিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করে।
আশুরার দিন, অর্থাৎ মহররমের ১০ তারিখে হোসনি দালান থেকে বের হয় ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন, সর্ববৃহৎ এবং ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল। কারবালার সেই অসম যুদ্ধের স্মরণে নির্মিত ইমাম হোসাইনের সমাধির প্রতিকৃতি ‘তাজিয়া’, ইমামের বিশ্বস্ত ঘোড়া ‘দুলদুলে’র প্রতীক, যুদ্ধের নানা স্মারক ও পতাকা নিয়ে এ বিশাল মিছিল যখন ঢাকার রাজপথে নামে, তখন এক অভূতপূর্ব ও হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। অংশগ্রহণকারীদের বুক চাপড়ানো মাতম, শোকের মর্সিয়া বা গীত, আর কান্নার রোল-সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এ মিছিল শুধু একটি ধর্মীয় প্রথা নয়, এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের চিরন্তন সংগ্রাম, সত্য ও আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের এক জীবন্ত প্রদর্শনী।
