Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ন্যায় বিচারের জন্য ধর্মের নসিহত

Icon

শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ন্যায় বিচারের জন্য ধর্মের নসিহত

দেশ টিকে থাকে ন্যায়বিচারের ওপর। যখন জাতীয় জীবন থেকে ন্যায়বিচার উঠে যায়, তখনই দেশ ও জাতি ধ্বংসের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। বনি ইসরাইলের বিচারব্যবস্থা ছিল ‘অর্থের জোরে হুকুম নড়ে’ এ ধরনের। যার টাকা বেশি ছিল সে বিচারব্যবস্থা পর্যন্ত কিনে নিত। আর যার টাকা ছিল না তার ওপর সব ধরনের আইনের প্রয়োগ চাপিয়ে দেওয়া হতো। আল্লাহতায়ালা সূরা নিসায় বনি ইসরাইলের ধ্বংসাত্মক বিচারব্যবস্থা উল্লেখ শেষে উম্মতে মুহাম্মাদিকে হেদায়াতি নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘ওয়া ইজা হাকামতুম বাইনান্নাসি আন তাহকুমু বিল আদলি। অর্থাৎ, যখন মানুষের মাঝে বিচার-ফায়সালা করবে ন্যায়-ইনসাফের সঙ্গে করবে।’ (সূরা নিসা, আয়াত ৫৮।) এ আয়াতে হুকুম শব্দটি দুবার এসছে। হাকামতুম ও তাহকুমু। দুটি শব্দেরই মূল বর্ণ হা-কাফ ও মিম। এ তিনটি বর্ণ দিয়ে আরবিতে হুকুম, হাকিম ও হিকমাহর মতো গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলো গঠিত হয়েছে। এ শব্দগুলো বাংলাভাষায়ও ব্যবহার হয়ে থাকে। হুকুম বলতে শাসন ও বিচারব্যবস্থা দুটিই বোঝায়। একইভাবে হাকিম বলতে বিচারক ও প্রশাসককে বুঝিয়ে থাকে। আর হিকমাহ মানে হলো গভীর প্রজ্ঞা। যে গুণটি বিচারক, প্রশাসক ও রাষ্ট্রপ্রধানের থাকা আবশ্যক।

আল্লাহতায়ালা রাষ্ট্রের প্রধান ও বিচারকদের প্রতি নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘যখন তোমরা বিচার-ফায়সালা করবে ন্যায়-ইনসাফের সঙ্গে করবে।’ আয়াতে ‘বাইনান্নাস’ বলা হয়েছে। নাস মানে হলো মানুষ। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, সালাফি-ওহাবি, শিয়া-সুন্নি, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি; যত ধর্ম, মত, পথ ও দল আছে সবার জন্য ন্যায়বিচার করতে হবে। নিজের দল বা পিরভাই হলে বিচার হবে এক রকম আর ভিন্ন মতের হলে বিচার হবে অন্য রকম-এ ধরনের বিচারব্যবস্থা কুরআন সরাসরি হারাম করেছে। ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনব্যবস্থা। সেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি পর্যন্ত আদালতের কাছে জবাবদিহির জন্য বাধ্য থাকতেন। যেমন-হজরত আলী (রা.) এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কাজী শুরাইয়ের আদালতে গিয়ে জবাবদিহি করেছেন। আবার ব্যক্তিগতভাবেই শাসকরা তৈরি করেছিলেন ন্যায়বিচারের অনন্য উদাহরণ। যেমন-খলিফা ওমর (রা.) চাকরকে উটে চড়িয়ে নিজে রশি ধরে পথ চলেছেন। মুফাসসিররা বলেছেন, ন্যায়বিচার এমন এক বিষয় যা সমাজ ও রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড সোজা রাখতে ভূমিকা রাখে। যে সমাজে ন্যায়বিচার নেই, সে সমাজ ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে থাকে। যে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার হারিয়ে যায়, সে রাষ্ট্রও এক সময় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ হয়। এক্ষেত্রে কুরআন খুব স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে, বিচারককে হতে হবে নিরপেক্ষ। দলীয়, ধর্মীয়, গোত্রীয় কিংবা ভৌগলিক পরিচয়ের কারণে বিচারে হেরফের করার সুযোগ নেই। (ফি জিলালিল কুরআন, ৪র্থ খণ্ড, ২২০ পৃষ্ঠা)।

আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত এ দেশের বিচারব্যবস্থায় কুরআনের নির্দেশ মতো সত্যিকারের ন্যায় ইনসাফ কায়েম হয়নি। শুধু তাই নয়, সময়ে সময়ে স্বৈরাচার সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল এমন নৈরাজ্যও দেখেছে দেশের মানুষ। দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও বিরোধী মত দমনের কৌশল হিসাবে বিচারের নামে চলেছে প্রহসন। শত শত নিরপরাধ মানুষ ফাঁসিতে ঝুলেছে এবং হাজার হাজার মানুষ অন্ধকার কারাগারে বন্দি জীবন বরণ করেছে। অন্যদিকে দলীয় লোক হওয়ার কারণে, অপরাধের পর অপরাধ করেও ছিল আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব যখন সাধারণ জনগণের সামনে প্রকাশ হতে থাকে তখন জনমনে বিচারব্যবস্থার ওপর এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়। পাশাপাশি দেশে বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। কুরআন থেকে জানা যায়, বনি ইসরাইলের শাসন ও বিচারব্যবস্থাও এ পর্যায়ে পৌঁছার পর পতন হয় ফেরাউনের মতো তুখোড় স্বৈরশাসকের। আমাদের গত শাসনব্যবস্থার দিকে যদি তাকাই তাহলে আমাদের চোখ কপালে উঠে যায় উন্নয়নের ফিরিস্তি দেখে। বাংলাদেশে গত ১৭ বছরে যেসব উন্নয়ন হয়েছে তার নজির এর আগে ছিল না। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, আধুনিক সব প্রযুক্তি কী না পেয়েছে দেশের জনগণ। কিন্তু সরকার যেটা নিশ্চিত করতে পারেনি সেটা হলো ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার না থাকার কারণে এর প্রভাব পড়েছে প্রত্যক্ষভাবে মানুষের লোকমায়। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করার পরও তাদের ব্যাপারে ন্যায়বিচার প্রয়োগের কথা কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি দেশের মানুষ। সবাই মেনেই নিয়েছে, এসব রথি-মহারথি ন্যায়বিচারের ঊর্ধ্বে। যে কারণে উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে মানুষকে বেশি দিন ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়নি। কিন্তু রাষ্ট্র যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করত তাহলে, উন্নয়ন কিছুটা ধীরগতির হলেও মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠত না।

আগামী দিনে দেশের শাসনব্যবস্থা যাদের হাতে আসবে তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নসিহত হলো-শাসনব্যবস্থায় যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা না যায় তাহলে আর কোনো কিছুই সঠিকভাবে কাজ করবে না। সে দল বা সরকারের পতন অনিবার্য। দুই দিন আগে বা পরে পতন হবেই হবে। আফসোসের কথা হলো, ক্ষমতার চেয়ারে বসার পর কেন যেন বেশিরভাগ মানুষ এ চির সত্যটি ভুলে অন্যায়-অবিচারে ডুবে যায়। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের শাসকদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার তাওফিক দিন। দেশের মানুষ যেন শান্তি-সমৃদ্ধির সঙ্গে বসবাস করতে পারেন এমন পরিস্থিতি আপনি তৈরি করে দিন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, জামালী তালিমুল কুরআন ফাউন্ডেশন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম