তরুণ সমাজের নতুন হুমকি ই-সিগারেট: বন্ধের সম্ভাব্য উপায়
ফারহানা জামান লিজা
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২০, ০৬:৫৯ এএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
তরুণ প্রজন্মকে নেশায় আসক্ত করতে হিট-নট-বার্ন বা ই-সিগারেট একটি নতুন অস্ত্র। সাধারণ সিগারেটের বিকল্প হিসেবে এই ইলেক্ট্রনিক সিগারেট বাজারজাত করা হলেও এটি আসলে একটি নেশা সৃষ্টিকারী পণ্য। এটি ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেমস (ইএনডিএস) হিসেবেও পরিচিত।
সিগারেটের মতোই দেখতে ফাইবার বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এই ব্যাটারিচালিত যন্ত্রগুলোর মধ্যে একটি প্রকোষ্ঠ থাকে। তার মধ্যে ভরা থাকে বিশেষ ধরনের তরল মিশ্রণ। যন্ত্রটি গরম হয়ে ওই তরলের বাষ্পীভবন ঘটায় এবং ব্যবহারকারী সেই বাষ্প টেনে নেয় ফুসফুসে, যা ধূমপানের অনুভূতি দেয়। এই পদ্ধতিকে ‘ভ্যাপিং’ বলা হয়।
ই-সিগারেটের স্বাস্থ্যঝুঁকি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হিট-নট-বার্ন বা ই-সিগারেট যে নামেই অবহিত করা হোক না কেন, এ ধরনের পণ্যকে শরীরের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট অনুযায়ী, ই-সিগারেট ব্যবহারে হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে। জাপানে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকারক।
হংকং কাউন্সিল অন স্মোকিং অ্যান্ড হেলথের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ই-সিগারেটে যে উপাদানগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন সেলের বিকল করাসহ ক্যান্সার হতে সাহায্য করে। ই-সিগারেটের তরল মিশ্রণের (ই-লিকুইড) মধ্যে থাকে প্রোপেলিন গ্লাইসল, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইসল, নানাবিধ ফ্লেভার ও নিকোটিন।
গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রাসায়নিকগুলো থেকে সাধারণ সিগারেটের ধোঁয়ার সমপরিমাণ ফরমালডিহাইড উৎপন্ন হয়, যা মানব শরীরের রক্ত সঞ্চালনকে অসম্ভব ক্ষতি করে।
ই-সিগারেটের তরল মিশ্রণের মধ্যে থাকে প্রোপেলিন গ্লাইসল, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইসল, নানাবিধ ফ্লেভার ও নিকোটিন। গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রাসায়নিকগুলো থেকে সাধারণ সিগারেটের ধোঁয়ার সমপরিমাণ ফরমালডিহাইড উৎপন্ন হয়, যা মানব শরীরের রক্ত সঞ্চালনকে অসম্ভব ক্ষতি করে।
এমন ক্ষতি সাধারণ সিগারেটেও হয় না বলে জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালোফোর্নিয়ার অধ্যাপক বেনোউইটজ। এ ছাড়া ই-সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে অতিসূক্ষ্ম রাসায়নিক কণা, যা মানব শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক।
এর থেকে গলা-মুখ জ্বালা, বমিভাব এবং ক্রনিক কাশি দেখা দিতে পারে। ই-সিগারেটের মধ্যে থাকা উত্তপ্ত গ্লিসারিন থেকে গঠিত একরোলিন খুব দ্রুত ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ব্যবহারকারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ই-সিগারেটে থাকা প্রোপাইলিন গ্লাইকোল কৃত্রিম ধোঁয়া তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
এটি ফুসফুস ও চোখে বিরক্তির উদ্রেক করে এবং এটি ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী। যেমন অ্যাজমা ও এমপাইসিমা। এ ছাড়া ই-সিগারেটে এরোসোল থাকে, যেটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এটি শরীরে শিরাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত তো করেই, পাশাপাশি শরীরে বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে। ই-সিগারেটের এরোসোলের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত বা টক্সিক ধাতু পাওয়া গেছে। যেমন টিন, নিকেল, ক্যাডিয়াম, লেড ও মারকারি।
তামাক কোম্পানির মিথ্যাচার
তামাক কোম্পানিগুলো ক্ষতি কমানো ও ধূমপান ত্যাগের উপকরণ হিসেবে হিট-নট-বার্ন বা ই-সিগারেটকে উপস্থাপন করতে চাচ্ছে। অথচ এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বরং প্রায় ৮,০০০ বিভিন্ন স্বাদ যেমন ফল, সফট ড্রিংকস, চকোলেট, পুদিনা এবং অন্যান্য বিভিন্ন ফ্লেভারে ই-সিগারেটগুলো ‘স্বাস্থ্যকর এবং ট্রেন্ডি পণ্য’ হিসাবে বাজারজাত করা হয়, যা মূলত কিশোর-কিশোরীদের কৌতূহল বাড়িয়ে তোলে এবং নেশায় আকৃষ্ট করে।
মূলত এ কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে– নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করা এবং তরুণদের এই নতুন নেশার পণ্য ব্যবহার করতে উৎসাহী করা।
আন্তর্জাতিক সংস্থা দি ইউনিয়ন ‘ইউনিয়ন পজিশন পেপার অন ই-সিগারেটস অ্যান্ড এইচটিপি সেলস ইন এলএমআইসিএস’ শীর্ষক একটি পজিশন পেপার প্রকাশ করেছে। পজিশন পেপারে দ্য ইউনিয়ন উল্লেখ করেছে, ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মূল টার্গেট হলো তরুণ প্রজন্ম।
গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভেতে তরুণদের ই-সিগারেটে ঝুঁকে পরার তথ্য উঠে এসেছে। সিগারেট ছাড়তে ই-সিগারেটের ব্যবহার পারতপক্ষে সিগারেট ছাড়তে সাহায্য তো করছেই না; বরং স্মোকাররা সিগারেট ও ই-সিগারেট দুটিই আসক্ত হয়ে পড়ছে। দি ইউনিয়ন অবিলম্বের ই-সিগারেট নিষিদ্ধের সুপারিশ করেছ।
আমেরিকার সারজেন জেনারেল কর্তৃক গবেষণায় দেখা যায়, ১৮-২৪ বছরের তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে মাত্র ০.০২ শতাংশেরও কম মানুষ ই-সিগারেট ব্যবহার করে ধূমপান ছাড়তে পেরেছেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে ই-সিগারেট
যুক্তরাষ্ট্রে ছয়জনের মৃত্যু আর অনেকের ফুসফুসের জটিলতা ধরা পড়ার পর ভেপিং বা ই-সিগারেট ব্যবহারের ক্ষতির দিকটি আলোচনায় আসে এবং পরে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে ই-সিগারেট। বিশ্বের অনেক দেশ ই-সিগারেটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এর ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছে এবং ইতিমধ্যে ৪২ দেশ তাদের দেশে ই-সিগারেটকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে এবং আরও ৫৬ দেশ ই-সিগারেট ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।
পাশাপশি আরও অনেক দেশ তাদের নিদির্ষ্ট কয়েকটি প্রদেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশে ই-সিগারেটের বর্তমান অবস্থা
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির গবেষণা সেল টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেলের (টিসিআরসি) গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে তরুণদের আকৃষ্ট করতে ই-সিগারেট দোকানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক গড়ে তোলা হয়েছে। তরুণদের আকৃষ্ট করতে তারা অবৈধভাবে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন তৈরি করছে।
ইউটিউব, ফেসবুক, ওয়েবসাইট ও অন্যান্য সামাজিকমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। এ ছাড়া তারা তাদের নিজস্ব কিছু চিকিৎসকের মাধ্যমেও যারা ধূমপান ছাড়তে চায়, তাদের প্রচলিত সিগারেটের বদলে ই-সিগারেট ব্যবহারে উৎসাহিত করছে।
আইনি সীমাবদ্ধতা
টিসিআরসির একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ই-সিগারেট নিয়ে স্পষ্ট কোনো আইন না থাকায় অহরহ-যত্রতত্র ই-সিগারেট বাংলাদেশে আমদানি ও বিক্রয় করা হচ্ছে অত্যন্ত সুলভ মূল্যে। শুধু দোকান কিংবা মার্কেটেই নয়, ই-সিগারেট বিক্রয় হচ্ছে অনলাইন মার্কেটগুলোতেও।
বর্তমানে ০.২ শতাংশ মানুষ ই-সিগারেট ব্যবহার করলেও খুব শিগগির যে এই সংখ্যাটি বেড়ে যাবে তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে ৬৬.২ শতাংশ ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দেয়ার কথা ভেবেছেন; কিন্তু তামাক কোম্পানি অপকৌশলের মাধ্যমে তাদের আবার ই-সিগারেটে আসক্ত করার চেষ্টা করছে। তাই এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
২০১৮ সালের আগে বাংলাদেশে ই-সিগারেট আমদানি সংক্রান্ত কোনো আইন, নির্দেশনা বা নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
সুপারিশ
বাংলাদেশে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের তামাকজাত দ্রব্যের যে সংজ্ঞা দেয়া আছে, তার মাধ্যমে ই-সিগারেটের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ ছাড়া ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মাধ্যমেও মাদক (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ধারা ৫ অনুযায়ী ই-সিগারেট আমদানি ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা সম্ভব।
বাংলাদেশে ই-সিগারেট খুব বেশি পরিচিত না হলেও বর্তমানে সিগারেট কোম্পানিগুলো তরুণদের মাঝে ই-সিগারেটের ব্যবহারে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ফ্লেভারে এবং বিভিন্ন কৌশলে ই-সিগারেটের প্রমোশনা চালাচ্ছে, যা আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
এ লক্ষ্যে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে সংশোধনে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তাই খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে রক্ষায় এখনই ই-সিগারেট বন্ধ করা উচিত।
লেখক: ফারহানা জামান লিজা
প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট
টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি)
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
