Logo
Logo
×

লাইফ স্টাইল

নাফাখুম রোমাঞ্চ : পর্ব-৩

ঝরনার আফসোস নিয়ে মেঘের কোলে ঘুম

Icon

শাহনেওয়াজ খান

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:৫১ পিএম

ঝরনার আফসোস নিয়ে মেঘের কোলে ঘুম

মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের ঘুম। ভোরেই জাগলাম। পাহাড়ি বৈশিষ্ট্য বহনকারী বাঁশের মাচার উপর তৈরি একটি ঘরে শুয়েছিলাম আমরা। ঘর থেকে বাইরে বেরুতেই অপরূপ দৃশ্য। চারদিকে মেঘ আর মেঘ। সবুজ অরণ্যের মাঝে লুটোপুটি খাচ্ছে আর উড়ে বেড়াচ্ছে। মেঘের উপর দিয়ে নিজেদের জানান দিচ্ছে বিশালাকার সেগুন গাছ।

এ রকমই বিশাল এক গাছের নিচে গতরাতেও বৃষ্টির মাঝে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আজ যেন মেঘ আশ্রয় নিয়েছে বড় বড় ওই গাছগুলোর কোলে। সেই মেঘ ছুঁয়ে আসা হালকা ঠাণ্ডা বাতাসে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। রাতে যে পাহাড়কে মনে হচ্ছিল বিভীষিকা; দিনে সেটাই যেন স্বর্গীয় উদ্যান! রাতের ক্লান্তি ও আতঙ্ক এক নিমিষেই উড়ে গিয়ে চোখ ও মনে ছড়িয়ে পড়লো অপরূপ মুগ্ধতা। এটাই বাংলাদেশের মাটির পাহাড়ের সৌন্দর্য।

উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘেরা সবুজ অরণ্যের মাঝে কয়েকটি ঘরবিশিষ্ট এলাকাটিকে অনেকটা আশ্রয়কেন্দ্রের মতো লাগছে। সারাদিন অরণ্যের মাঝে পরিশ্রমের পর একটু মাথা গোঁজার আশ্রয়। একে ঘিরেই গড়ে উঠেছে গুটিকয়েক পরিবারের নিত্যদিনের হাসি-কান্না, রীতি-নীতি। ঘর-বাড়িগুলো ঘুরে দেখার পর প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে ফজরের নামাজের জন্য অযু করলাম। অযু শেষে ফিরতেই দেখি কাঁদামাখা শরীর নিয়ে এক মেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠছে।

মোটাসোটা মেয়েটি কাছাকাছি আসতে বুঝলাম তিনিও একজন পর্যটক। এখানে এসেছেন আমাদের মতো পদ্মঝিরি ট্রেইল ধরে। পুরো শরীর কাঁদা-পানিতে একাকার। হাতে-পায়ে কোথাও কোথাও রয়েছে রক্তের ছাপ। কোথা থেকে এসেছেন জিজ্ঞাসা করতেই গাইডের উপর একরাশ রাগ ঝেড়ে জানালেন, সারারাত ধরে হেঁটে এখানে পৌঁছেছেন। তার দলের বাকি লোকজনও আসছেন। পথে কয়েকবার পাহাড় থেকে পড়ে গেছেন। পাথরেও আঘাত পেয়েছেন কয়েকবার। এতেই শরীরের এই হাল। তাকে বাঁশের বেড়ায় ঘেরা স্থানীয় ওয়াশরুম ও পানির সন্ধান দিয়ে নামাজ পড়তে গেলাম।

একে একে সবাই ঘুম থেকে উঠে নতুন যাত্রার প্রস্ততি নিলো। অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি আর সকালের মনোরম আবহাওয়ায় সবাই বেশ ফুরফুরে। স্থানীয় দোকান থেকে নাস্তা খাওয়া ও ফটোসেশন শেষে শুরু হলো থুইস্যাপাড়া অভিমুখে যাত্রা। পাহাড়, পাথুরে গুহা ও ঝিরিপথ ডিঙিয়ে চলছি আমরা। গত রাতের বিভীষিকার পর এখন বুঝছি পথের সৌন্দর্য। ক্লান্তি হারিয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্যের মাঝে। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছড়াগুলো সত্যিই অনিন্দ্য সুন্দর। ছড়ার ঠাণ্ডা পানিতে জুড়ায় ক্লান্তি।

থুইস্যাপাড়ার পাহাড়ে উঠার সময় বুঝতে পারলাম গত রাতে হাঁটার ফল। পা যেন চলতে চাইছে না। ব্যথায় হাঁটু ধরে আসছে। প্রতি পদক্ষেপেই হাঁটুর জয়েন্টের হাড়ে ব্যথা টের পাচ্ছি। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে অনেক কষ্টে পৌঁছালাম আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্য—থুইস্যাপাড়া।

রাসূল (সা.) বলেছেন, মানুষ চেনা যায় লেনদেন ও সফরের মধ্য দিয়ে। সফরকালে দেখছি একেকজনের কথা ও কাজে কত মিল! কথা যদি আসমানে থাকে তো কাজ মাটিতে! আর ক্ষণে ক্ষণে কত রং! এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। যে বাড়িতে পৌঁছালাম তারা সকালের নাস্তা প্রস্তুত করে রেখেছিল। হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করে কিছুটা বিশ্রাম নিলাম সবাই। শরীরকে আরেকটু চাঙা করতে সকাল সকালই গোসল করলাম। পাহাড়ে সঞ্চিত পানি মোটর দিয়ে উপরে উঠানো হয়। চৌবাচ্চা থেকে পানি নিয়ে গায়ে দিতেই ক্লান্তি যেন নেমে গেল। এত নির্মল পানি যেন কত বছর গায়ে পড়েনি! পাহাড়ি এই পানি গায়ে লেগে থাকবে কয়েক বছর!
এরপর সবার সঙ্গে দেবতাপাহাড় আর আমিয়াখুম জলপ্রপাত যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার চেষ্টা। গোসলে শরীর চাঙা হলেও হাঁটুর ব্যথা তখনও ভোগাচ্ছিল। চাইলে হয়ত যেতে পারতাম।

কিন্তু দেবতাপাহাড়ের ৯০ ডিগ্রি কোণ বেয়ে উঠা-নামার পর ব্যথার কী অবস্থা হবে সেটা ভেবে আর সাহস করিনি। জীবনে এই প্রথম কোনো ভ্রমণে এসে আকাঙ্ক্ষিত কোনো গন্তব্যে যেতে অস্বীকৃতি জানালাম। প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকলেও শরীরের কথা চিন্তা করে রাজি হচ্ছিলাম না। তবে কারণ হিসেবে হাঁটুর ব্যথার বিষয়টি লুকিয়ে যাই। ব্যথা কম-বেশি সবারই আছে। কিন্তু ব্যথার কারণে যাচ্ছি না—বিষয়টি জানালে পর্যটকের মান কি আর থাকে!
যে ঘরে ছিলাম তার সাথে বড়সড় বারান্দামতো মাচা রয়েছে। বিশাল পাহাড়ের উপর বাঁশের তৈরি এই উঁচু মাচায় শোয়ার পর যেন মনে হলো পাহাড়ের উপর ভাসছি। অপরপাশের পাহাড়ের কোলে শুয়ে আছে মেঘ। এক অসাধারণ দৃশ্য, অনন্য অনুভূতি। আমিয়াখুম না যাওয়ার আফসোস ও দুঃখে যেন প্রলেপ দিয়ে দিলো এই আবহ। ছোট্ট পাড়াটি ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগলো।

কিছুটা দূরের এক পাহাড়ে বিজিবির ক্যাম্প। অপরপাশে আরেক পাহাড়ে উঠার রাস্তা রয়েছে। দু-একজন পর্যটক সেখানে যাচ্ছে দেখে আমি আর তাহসিন সেখানে গেলাম। উপরে উঠার পর দেখলাম, ছোট্ট এক বাঁশ পোতা রয়েছে। এর উপর মোবাইল ফোন রাখলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। দারুণ ব্যাপার। থানচি রওনা হওয়ার পর প্রথমবারের মতো বাসায় ফোন দিলাম। জানলাম, সবাই ঘূর্ণিঝড় বুলবুল এবং আমাদের খবর না পাওয়া নিয়ে চিন্তিত। যাক ভালোই হলো, সর্বশেষ খবর জানাতে ও জানতে পারলাম। এরপর শাওন ও অপর সফরসঙ্গী গেল কথা বলতে। মূলত, মানুষজন ফোনে কথা বলতেই ওই পাহাড়ে যায়।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থেমে থেমে বৃষ্টি শুরু হলো। কিছুক্ষণ বাইরে, কিছুক্ষণ ভেতরে এভাবেই কাটছিল সময়। দুপুরের দিকেই আমিয়াখুম দর্শন শেষে বাকিরা ফিরে আসলো। ঝরনার চমৎকার বর্ণনার চেয়ে বেশি শুনলাম ভোগান্তির বর্ণনা। বৃষ্টিতে কাঁদাময়-পিচ্ছিল রাস্তায় খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠা-নামার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিল সবাই। ভালোভাবে ফিরতে পেরেই শুকরিয়া। বৃষ্টির কারণে ঝরনায় বেশি সময় না কাটিয়ে দ্রুত ফিরতে হয়েছে। ভারী বৃষ্টির পর দেবতাপাহাড় বেয়ে উঠে আসা প্রায় অসম্ভব।

একাধিক পর্যটক দল দেবতাপাহাড় গিয়ে আমিয়াখুম না দেখে ফেরত আসার গল্পও শুনলাম। আমাদের দলনেতা আল-আমিন বারবারই বলছিল, আমরা না গিয়ে ভালো করেছি। স্বান্তনা না সত্যি—এ নিয়ে সন্দেহ থাকলেও যাত্রার বর্ণনা শুনে না যাওয়ার আক্ষেপ চলে গেল।

ফারুক, সিফাত, নাওমী, তাপস, নওয়াজেশ, তাশাওয়ার, মুস্তফা আমীন—সবার মুখেই ভয়ঙ্কর যাত্রার বর্ণনা। আল-আমিন যখন বারবার আমাদের না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছিল তখন সত্যিই আফসোস কমে যায়। ১৩ জনের মধ্যে আমরা যে চারজন যাইনি তারা কিছুটা পুলকিত বোধ করলাম।

বৃষ্টির কারণে বিকালে তেমন ঘুরার সুযোগ হলো না। সন্ধ্যা নাগাদ প্রতি ঘরে ঘরে এসে পর্যটকদের নাম-ঠিকানা নিয়ে গেলেন বিজিবির সদস্যরা। জানিয়ে গেলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পূর্বাভাস। এরই সঙ্গে সতর্কবার্তা—পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো পর্যটক পাড়ার বাইরে যেতে পারবে না। এত কষ্ট করে এত দূর এসেও নাফাখুম দর্শনের আনন্দদায়ক আবহ মিলবে না? ফিরতি যাত্রাও অনিশ্চিত। রাজ্যের দুশ্চিন্তা আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে করতে ঘুমাতে গেলাম। বৃষ্টির ফোঁটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দুশ্চিন্তাও। (চলবে…)

লেখক: সাবেক গণমাধ্যমকর্মী

নাফাখুম রোমাঞ্চ: পর্ব-২ : বুনো পাহাড়ে রাতের যাত্রী

নাফাখুম রোমাঞ্চ: পর্ব-১ : সম্ভব-অসম্ভবের বাঁকে সৌন্দর্যের লুকোচুরি

নাফাখুম দৃশ্য ভ্রমণ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম