রিয়ালে সর্বজয়ী, আনচেলত্তি এবার ব্রাজিলের সুসময় ফেরাতে পারবেন তো?
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ১১:১৬ এএম
কার্লো আনচেলত্তি/ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ক্লাব ফুটবলের কিংবদন্তি কোচ তিনি। এক রিয়াল মাদ্রিদের হয়েই তো জিতেছেন সবকিছু। তার আগে এসি মিলান, চেলসি, পিএসজি, বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে কতো কি জিতলেন, তার কোনো ইয়ত্তাই নেই। তবে ২৬ মে থেকে শুরু হচ্ছে তার নতুন এক অগ্নিপরীক্ষা। নতুন এক ভূমিকায় দেখা মিলবে ‘ডন’ কার্লো আনচেলত্তির। বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিলের কোচ বনে গেছেন তিনি।
রিয়াল মাদ্রিদে দুই দফায় কাজ করেছেন তিনি। দুই দফাতেই জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। কোপা দেল রেও দুই দফাতেই, মাঝে রিয়াল মাদ্রিদ আবার এই শিরোপাটা জিততে পারেনি ৯ বছর। প্রথম দফায় লা লিগা জেতা হয়নি, শেষ দফায় জিতেছেন দুটো।
চলতি মৌসুমটা ভুলেই যেতে চাইবেন আনচেলত্তি। তবে এ মৌসুমেও দলটা যা করেছে, তা আর যাই হোক সামান্য কিছু আদৌ নয়। চলতি মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের রক্ষণ নিয়ে সমস্যা ছিল প্রায় প্রতি ম্যাচেই। শুরু থেকে অভিজ্ঞ দানি কারভাহাল ছিলেন না, এরপর সময়ে অসময়ে বড় বড় ডিফেন্ডারদেরও হারিয়েছেন কার্লো। তবে এরপরও তার দল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ আটে খেলেছে, লিগের ৩৫ ম্যাচ পর্যন্ত লড়াই করেছে, কোপা দেল রে আর সুপার কোপার ফাইনালেও খেলেছে, এত সমস্যার পরও এমন সব মঞ্চে চলে যাওয়াটা খারাপ নয় নেহায়েত। দলটা রিয়াল মাদ্রিদ না হলে এই মৌসুমকেও বেশ করে মূল্যায়ন করার কথা বৈকি!
এবার তিনি যেখানে যাচ্ছেন, তাদের স্বভাবও রিয়ালের মতোই। অল্পেতে মন ভরে না। আপনি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলে ফেলতে পারেন বটে, কিন্তু শিরোপা না এনে দিলে আপনাকে শূলে চড়তেই হবে। এমন সব লক্ষ্য নিয়েই কার্লোর দুয়ারে ধর্ণা দিয়েছে ব্রাজিল। সবকিছু জেনে বুঝে তবেই সেলেসাওদের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন আনচেলত্তি।
বিদেশী একজন কোচ জাতীয় দল সামলাচ্ছেন, ব্রাজিল নিজেদের ইতিহাসে এমন কাজ করেনি আর কখনোই। এমনকি বিশ্ব ফুটবলেও এমন কিছুর দেখা খুব কমই মেলে। আর যদি বিশ্বকাপের ইতিহাস ঘেটে দেখেন, তাহলে দেখবেন বিদেশী কোনো কোচের অধীনে কখনোই কোনো দল বিশ্বকাপ জিততে পারেনি।
এত বিরুদ্ধ ইতিহাসের পরও কার্লোর কাছেই গেল ব্রাজিল; সেটাও আবার এক বার নয়, একাধিকবার। সেই ২০২৩ সাল থেকে আনচেলত্তির আশায় অপার হয়ে বসে ছিল দলটা। বারদুয়েক না করে অবশেষে বিশ্বকাপ থেকে এক বছরের দূরত্বে দাঁড়িয়ে দায়িত্বটা নিলেন ইতালিয়ান এই সর্বজয়ী কোচ। দায়িত্বটা নিলেন এমন এক সময়ে, যখন বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দলটা ধুঁকছে, বিদায়ের শঙ্কা অবশ্য নেই, কিন্তু এই দল নিয়ে বিশ্বকাপের আশা করা যাচ্ছে না, ঠিক এমন সময় দলের দায়িত্বটা নিলেন আনচেলত্তি।
তার পোর্টফোলিওটা দেখুন। রিয়াল মাদ্রিদ, চেলসি, এসি মিলান, পিএসজি, বায়ার্ন মিউনিখে তিনি ফুটবল ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় ইগোওয়ালা খেলোয়াড়দের সামলেছেন, ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ও তার অধীনে খেলেছেন, সফল হয়েছেন। একই সঙ্গে ক্লাবকেও সন্তুষ্ট রেখেছেন। শেষ বৈশিষ্ট্যটা ব্রাজিলের জন্য আপাতত খুব জরুরি কিছুই ছিল। তিতে পরবর্তী যুগে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন কোনো কোচের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল সম্পর্কে যেতেই পারছিল না। রেমন মানেজেস, ফের্নান্দো দিনিজ থেকে শুরু করে দরিভাল জুনিয়র, সবার সঙ্গেই সম্পর্ক খারাপ হয়েছে বোর্ডের, শেষমেশ তাদেরই যেতে হয়েছে।
এদিকে ব্রাজিল স্কোয়াডেরও ম্যান ম্যানেজারই বুঝি বেশি দরকার ছিল। ব্রাজিল প্রতিভার দিক থেকে আর যাই হোক কখনো দরিদ্র ছিল না, এখনও নেই। তাদেরকে ঠিকঠাক সামলে নেওয়ার মতো একজনই প্রয়োজন ছিল। কার্লো আনচেলত্তি সেই একজন। ব্রাজিল কিংবদন্তি জিকো তাই বহু আগে বলেছিলেন, ‘আনচেলত্তি এখন আমাদের জন্য আদর্শ হতে পারেন, কারণ তাকে সবাই, এমনকি তার প্রতিপক্ষও বেশ শ্রদ্ধা করে।’ ব্রাজিল ফুটবলের রাজনীতির অস্থিতিশীলতা এড়িয়ে দলটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা যদি কেউ পারেন, সেটা এই মুহূর্তে আনচেলত্তিই পারবেন।
এ গেল একটা বিষয়। সঙ্গে যোগ করুন রিয়াল মাদ্রিদে তার শিষ্যদের সঙ্গে তার সম্পর্কটাও। ব্রাজিল দলের নিয়মিত তিন মুখ ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো গোয়েজ আর এডার মিলিতাও, এদের সরাসরি কোচ ছিলেন আনচেলত্তি। তার অধীনেই নিজেদেরকে মেলে ধরেছেন এই ফুটবলাররা। ভিনি জাতীয় দলে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন এখন। পুরো ক্যারিয়ারে টানা গোল অ্যাসিস্ট করেছেন মোটে এক বার। ৩৯ ম্যাচ খেলে গোল মোটে ৬টি। যাকে ভবিষ্যতের নিউক্লিয়াস ভাবা হয়, তার এমন পারফর্ম্যান্স নিশ্চয়ই ব্রাজিলকে স্বস্তি দেয় না।
ক্লাব ফুটবলে ভিনির বিধ্বংসী রূপ ‘আনলক’ করা আনচেলত্তির চেয়ে ভালো কাউকে এখন আর পেতেই পারত না ব্রাজিল। এদিকে নেইমার যদি ঠিক সময়ে ফিরে আসেন, তখন কার্লোর জন্য কাজটা সহজই হবে বৈকি! সঙ্গে যোগ করুন আনচেলত্তির নকআউট টুর্নামেন্টের মুনশিয়ানাকে। তখন ব্রাজিল সমর্থকরা আশায় বুক বাধতেই পারেন।
আর যদি হিসেবে আনা হয় আনচেলত্তির কথা, তাহলে এই দায়িত্বটা তার জন্য আর দশটা চ্যালেঞ্জের মতো নয়, এটা রীতিমতো কোচিং জগতের সর্বকালের সেরা হওয়ার সুযোগও। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে শিরোপা জেতা একমাত্র কোচ তিনি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জিতেছেন ৫ বার। এর সঙ্গে যদি বিশ্বকাপের সোনার হরিণটাও যোগ হয়, তাহলে তিনি নিশ্চিত করেই সর্বকালের সেরা কোচের আলোচনায় চলে আসবেন।
২০০২ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার পর এক এক করে ১১ মৌসুম শিরোপাটা জিততে পারেনি রিয়াল মাদ্রিদ। ২০১৩-১৪ মৌসুমে সে খরাটা কাটে আনচেলত্তির হাত ধরে, পরম আরাধ্য ‘লা ডেসিমা’ সে বছর জেতে রিয়াল। ২০০২ সালটা রিয়াল আর ব্রাজিলকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিচ্ছে। ইতিহাসের সফলতম দল ব্রাজিলের সবশেষ বিশ্বকাপ জেতার ইতিহাসটা সে বছরই। এবার আনচেলত্তির হাত ধরে বাকি ইতিহাসটাও মিলে যাক, এমনটাই নিশ্চয়ই চাইবে সেলেসাওরা।




