Logo
Logo
×

খেলা

ইতিহাসের এই দিনে

কার্ডিফে সেদিন রূপকথা লিখেছিল বাংলাদেশ

নেয়ামত উল্লাহ

নেয়ামত উল্লাহ

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৫, ০৩:৫২ পিএম

কার্ডিফে সেদিন রূপকথা লিখেছিল বাংলাদেশ

আতহার আলী খান ততদিনে অবসরে চলে গেছেন। ভূমিকাটা বদলে গেছে। স্টাইলটা ঠিকই আছে, ওপেনার থেকে তার কাজটা হয়ে গেছে ধারাভাষ্যকারের। বাংলাদেশ দল তখনও নিয়মিত জিততে জানে না। দল যখন মাঠে পর্যুদস্ত হয়, কমেন্ট্রি বক্সে বসে রাজা-উজিরদের দেশের লোকেদের মুখে টীকাটিপ্পনী শুনতে হয় তাকেও।

সেদিন তার কদরটাও বেড়ে গেল যেন। প্রেস বক্সে একগাদা সাদা ধারাভাষ্যকার তোয়াজ করছেন আতহারকে। কেউ একজন তো সেদিনের পত্রিকা ভাঁজ করে রীতিমতো বাতাস করতে বসে গেছেন তাকে। কেন? মাঠে যে তার দল রীতিমতো অসাধ্য সাধন করে ফেলছে!

অস্ট্রেলিয়া তখন বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ের ১ নম্বর দল। আর বাংলাদেশ? র‍্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে থাকা একটা অস্তিত্বমাত্র। এইতো বছরখানেক আগেও যারা ৪৭ ম্যাচ জয়হীন ছিল তারা। আর অস্ট্রেলিয়া সে বছর ১৩ ম্যাচের একটাই কেবল হেরেছিল। তবে দলটা কেমন ছিল, তা সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে ভারত। এক বিশ্বকাপসহ দুই ফাইনালে ৩৫৯ রান হজম করে হারের দগদগে ঘাঁ যে সৌরভ গাঙ্গুলীর অদম্য ভারত পেয়েছিল এই অস্ট্রেলিয়ার কাছেই!

তবে সে যাই হোক, সে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ধারেভারে তুলনাতেই আসে না সেই সময়ের বাংলাদেশ, ফর্মটা যতই পক্ষে কথা বলুক, এরপরও। অস্ট্রেলিয়া এমনিতেও বাংলাদেশের প্রতি সমীহ দেখায় থোড়াই। সে ম্যাচের বছরখানেক আগে যখন দল গেল ডাউন আন্ডার সফরে, তখন বাংলাদেশের ম্যাচ নিয়ে যাওয়া হলো অস্ট্রেলিয়ান সামারের বাইরে; ব্রিসবেন, মেলবোর্ন, সিডনির মতো ভেন্যু রেখে খেলানো হলো কেয়ার্ন্সের মতো মাঠে, যেখানে পিচও নেই, খেলতে হয় ড্রপ ইন পিচ বসিয়ে।

২০ বছর আগে আজকের এ দিনেও শুরুতে বাংলাদেশকে সমীহ দেখানোর মেজাজে ছিল না অস্ট্রেলিয়া। কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন্সে ওই ম্যাচের আগে ৪টি খেলা হয়েছে, প্রত্যেক ম্যাচেই জিতেছে শেষে ব্যাট করা দল। এরপরও অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক রিকি পন্টিং যখন টস জিতলেন, নিলেন ব্যাট করার সিদ্ধান্ত। ‘পুঁচকেদের বিপক্ষে জিততে হলে কি আর ওসব ইতিহাস মনে রেখে ছক কষতে হয় নাকি!’ ভাবটা বোধ হয় ছিল এমনই!

সেই অস্ট্রেলিয়া ব্যাট করতে এলো। ০ রানে ১ আর ৯ রানে চলে গেল অস্ট্রেলিয়ার ২ উইকেট। প্রথম ধাক্কাটা মাশরাফি বিন মুর্তজা দিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে, পরেরটা তাপস বৈশ্য দিলেন রিকি পন্টিংকে। দুজনের সম্মিলিত রান তখন ১! এমন শুরুর পর বাংলাদেশ রীতিমতো অবিশ্বাস্য কিছু করার স্বপ্নে বিভোরই হয়ে গিয়েছিল।


তবে মুখে পানি ছিটিয়ে সে স্বপ্ন ভাঙালেন ডেমিয়েন মার্টিন, মাইকেল ক্লার্করা। দুজনের ফিফটির সঙ্গে শেষ দিকে মাইক হাসি আর সাইমন ক্যাটিচের ক্যামিওতে ভর করে অস্ট্রেলিয়া তুলে ফেলল ২৪৯ রানের ‘পাহাড়’। দারুণ শুরুর সুখস্মৃতি উবে গিয়ে তখন মনে হচ্ছিল এ যেন পুরোনো গল্পেরই পুনরাবৃত্তি। এমন সব ক্ষণিকের সুখ তো আগে বহুবারই পেয়েছে বাংলাদেশ, শেষে হারের ব্যথাও সয়েছে বহুবার।

বাংলাদেশ ব্যাট করতে নামল। ধীরে চলো নীতিতে এগোতে থাকল, পাল্লা দিয়ে খোয়াতে থাকল উইকেটও। তৃতীয় উইকেটটা যখন গেল ১৯ রান করা জাভেদ ওমর যখন ফিরছেন মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচের শিকার বনে, তখন স্কোরবোর্ডটা দেখাচ্ছিল ৭২-৩, ২০.৫ ওভারের খেলা শেষে। সে পরিস্থিতি থেকে অস্ট্রেলিয়ার জেতার সম্ভাবনা ছিল অন্তত ৮০ ভাগ।

কেন? টি-টোয়েন্টির জন্ম হলেও তখনও যে তা রমরমা বাজার সাজিয়ে বসেনি। ১৭৫ বলে ১৭৮ রান তাই তখনও এভারেস্টসম। আর তাড়া করতে নামা দলটার নাম বাংলাদেশ, যাদের ব্যাটিং লাইন আপটা রীতিমতো তাসের ঘর! সেসব হিসেব মগজে থাকলে তখন তা রীতিমতো ‘অসাধ্যই’ ঠেকার কথা আপনার।

সেই অসাধ্যটাই সাধন করতে হলে চতুর্থ উইকেটে হাবিবুল বাশার কিংবা মোহাম্মদ আশরাফুলের কেউ একজনকে অসামান্য কিছু করতেই হতো। সে অসামান্য কাজটাই করলেন দুজনে। 

নাম ভূমিকায় ছিলেন আশরাফুল। ক্যাসপ্রোভিচকে ল্যাপ স্কুপ করে চার মেরে হাত খুললেন। শেষ করলেন গ্লেন ম্যাকগ্রাকে সুইপ করে চার মেরে। মাঝে যা করলেন, সেটাই বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিল অবিশ্বাস্য এক অর্জনের খুব কাছে। ১৩৮ বলে ১৩০ রানের জুটিতে হাবিবুলও সঙ্গ দিয়েছেন তাকে, খেলেছেন ৪৭ রানের মহামূল্য এক ইনিংস। তিনি বিদায় নিলেন দলকে ২০২ রানে রেখে। এরপর আশরাফুল যখন সেঞ্চুরি করে ফিরছেন সাঝঘরে, তখন বাংলাদেশ জয় থেকে আর মোটে ২৩ রানের দূরত্বে। 

বল ১৭টা হাতে থাকলেও উইকেটে যখন আফতাব আহমেদ আর মোহাম্মদ রফিকদের মতো হার্ড হিটাররা আছেন, তখন লক্ষ্যটা তো মামুলিই! আফতাব আর রফিক মিলে সেটা ১৩ বলেই পার করে ফেলে তার প্রমাণটাও দিলেন ভালোভাবেই। অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর স্বপ্নটা তাতেই আর কষ্টকল্পনা রইল না। অনেক দূরের অরূপ রতন, ধরা দিল হাতের মুঠোয়।

‘অন দ্য রিখটারস্কেল, দিস ইজ আফটারস্কেল’ — জেসন গিলেস্পিকে লং অনের ওপর দিয়ে ছক্কা মারার পরের বলে হুড়মুড়িয়ে সিঙ্গেলটা নিয়ে যখন বাংলাদেশকে পরমানন্দে ভাসালেন আফতাব, ঠিক তখন আমুদে ধারাভাষ্যকার ডেভিড লয়েড তখন কানে যেন মধু বর্ষালেন এই বলে। 

সেই জয় আফটার স্কেলই বটে। যদিও সে সিরিজের আগের ঠিক দুটো সিরিজে দুটো অবিস্মরণীয় অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। ভারতকে হারিয়েছিল, এরপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জিতেছিল সিরিজ। সে ভারত অবশ্য ছিল খর্বশক্তির, জিম্বাবুয়েও ছিল বিগতযৌবনা, তার ওপর জয়গুলো ছিল নিজেদের দেশে, তাই ৪৭ ম্যাচের জয়খরাকে পেছনে ফেললেও সমালোচকদের মুখটা বন্ধ হচ্ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই জয় সেসবও বন্ধ করে দিয়েছিল। বিশ্বক্রিকেটকেও দিয়েছিল বার্তা, ‘আমরা আর পুঁচকে দলটা নেই’ এই বার্তা। এই সব এসেছিল ২০ বছর আগের আজকের এই দিনে।


Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম