ইস্ ঢাকার বাতাসে বিষ
ধূলিসমুদ্র পেরিয়ে সীসানগরীতে
শফিক হাসান
প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নামের সঙ্গে কাজের মিল যেহেতু দেশে নেই- রাজধানী ঢাকার অনেকাংশই খোলা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। নগরবাসীও সবকিছু খোলাখুলিভাবে বুঝবে।
কিন্তু জামাল উদ্দিনের ক্ষেত্রে ফলতে লাগল উল্টো। যাদের সঙ্গে ঘর-গেরস্তি, তারাই বলতে শুরু করল, জামাল উদ্দিনের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে, চিকিৎসা জরুরি। ডাক্তারের খোঁজে ব্যতিব্যস্ত স্বজনরা। অন্যদিকে তিনি উপলব্ধি করেন সমস্যা সারা শরীরে। নাকে, চোখে, পেটে, পায়ে- ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের কোথায় নয়!
সেদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে মেজাজ চড়ল। দু’হাত ভর্তি সওদাপাতি কিনেছেন। সেগুলো রেখে চাপমুক্ত হয়ে বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। বিধিবাম, সোফাকে বিছানা বানিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে কোনো এক নবাবজাদা। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘আপনি কে ভাই?’
মুখ ঝামটে তার স্ত্রী বললেন, ‘বলিহারি! ছেলেকে ডাকছে ভাই। চোখের মাথা খেয়েছ?’
থতমত খেলেন জামাল উদ্দিন। নিজের ভুলে মনোযোগ না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলেন, ‘চোখের মাথাটা কোথায় থাকে, গিন্নি? চোখের কোন পাশে!’
ত্যাঁদড় পুত্রধন উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। হেসে বলে, ‘আব্বু বোধহয় আজকাল রাজ্জাক-বাপ্পারাজের সিনেমা দেখে। সিনেমায় বাপ্পারাজ রাজ্জাককে মামা, ভাইয়া, চাচা... কতকিছু বলে ডাকেন!’
‘দেখবে কী, নিজেই জীবনভর সিনেমা দেখিয়ে গেল। ভাগ্য ভালো, কখনো আমাকে খালাম্মা ডাকেনি!’
সায় দিলেন, ‘কথাটা মন্দ বলোনি, জলি। নিরানন্দ সিনেমা হলে পোস্টার দেখলাম- বিষে ভরা নাগিন।’
জামাল উদ্দিন ভেবেছেন এমন উসকানিতে গিন্নি ফোঁস করে উঠবে। তেমন কিছু হলো না। পরিস্থিতি শান্ত হলে ভুলের উৎস খুঁজতে সচেষ্ট হলেন। বেশিদূর ভাবতে হলো না। চশমায় জমেছে দেড় ইঞ্চি পরতের ধূলি! প্রতিদিনের চেনা রাস্তা বলেই ক্ষীণ দৃষ্টিতে যাতায়াত করতে পারেন। তাই বলে আÍজকে চিনবেন না, মানা যায়!
দুই.
স্বপ্রণোদিত হয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, ল্যাব টেস্ট লিখে প্রশ্ন করলেন, ‘সকালে কী খান?’
‘ধূলি।’
‘লাঞ্চ সারেন কী দিয়ে?’
‘ধূলি।’
‘রাতের বেলায়?’
‘ধূলি।’
‘অফিসে বসের ধমক, বাসায় বউয়ের ঝাড়ি খান না?’
‘ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছেন কেন? পেট বা মনের ডাক্তারের কাছে আসিনি। এসেছি চোখের ডাক্তারের কাছে।’
‘ভুল বলছেন, আমি হাঁটু রোগ বিশেষজ্ঞ।’
টনক নড়ল জামাল উদ্দিনের। বেহুদাই সময় আর অর্থ নষ্ট করেছেন। চোখ দুটো না পাল্টালে আর হচ্ছে না। ভালো মানের দুটি চোখের দাম কত পড়বে? বেশিক্ষণ ভাবনার ফুরসত পেলেন না। পরিচিত সবজিওয়ালা ডাকল, ‘খাঁটি ফরমালিন মাখানো কাঁচকলা আছে। দুই হালি দিই, স্যার?’
‘ওইদিন বেগুন দিয়েছিলে। পরে সেটা মুলা হয়ে গেল কীভাবে?’
‘ওইদিন তো খোলা ম্যানহোলে পড়ে গিয়েছিলেন। ভেতরে থাকা অন্য কারও সঙ্গে অদল-বদল হয়েছে হয়তো।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জামাল উদ্দিন। ম্যানহোলে পড়ার ঘটনা সত্য। চোর-চোট্টারা ঢাকনি খুলে নিয়ে বেচে দেয়।
তিন.
সকালটা ভালো না কাটলে দুপুরটাও সুবিধার হয় না। প্রমাণ পেলেন ফের। বিবাহবার্ষিকীর তারিখ মনে রাখতে পারেননি জামাল উদ্দিন। সকালে গিন্নি আচানক হাতে একগুচ্ছ ফুল তুলে দিয়ে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাল। আবেগে জামাল উদ্দিন ফুল ছোঁয়ালেন নাকে, ‘একটুও সুগন্ধ নেই। কাগজের ফুল নাকি?’
‘মিনসের সঙ্গে কথা বলাই অপরাধ! গন্ধে ম-ম করছে, তিনি প্লাস্টিকের নাকে গোলাপ শুঁকছেন!’
‘প্লাস্টিক সার্জারি করলে ভালোই হতো। প্রতিদিন নাকটা খুলে নিয়ে ফুটোর ধূলি-ময়লা ধুয়ে যথাস্থানে রেখে দিতাম।’
‘আক্কেল-জ্ঞানও লোপ পেয়েছে!’
অভিন্ন কথাই ঘণ্টাদুয়েক পর বস বললেন অন্যভাবে, ‘কী লিখেছেন ফাইলে? সিসানগরী, বাংলাদেশ!’
‘মাঝে-মধ্যে অজান্তেই প্রকৃত নাম চলে আসে কলমে। ঢাকা এখন সত্যিকার অর্থেই সিসানগরী। নাকে প্রতি মুহূর্তে ঢুকছে সিসা। দিশাহীন নাক আপনার পারফিউমের ঘ্রাণও পায় না, স্যার।’
বস কঠিন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বাঁচিয়ে দিল অফিস সহকারী। এসে
সে জানাল, অতিথি এসেছে।
চার.
বন্ধুর প্রচ্ছদপট দেখেই চমকালেন জামাল উদ্দিন। এমন সাজ-পোশাক নায়িকাদের মানিয়ে যায়, তাই বলে মধ্যবয়সি একজন পুরুষও!
‘সমস্যা কী, কস্টিউম পরেছিস কেন?’
‘নতুন ফ্যাশন। খারাপ লাগছে?’
‘এই ধূলিসমুদ্রে তো সাঁতরানোর সুযোগ নেই। কস্টিউম কী কাজে আসে!’
‘মজাটা দেখ এবার।’ বলে বন্ধু নিজের বুকে আঙুল ছোঁয়ালেন। উন্মুক্ত হলো রোমশ বুকের একাংশ। এতক্ষণে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন জামাল উদ্দিন। তার চোখ ডালের বড়ার রূপ ধারণ করল। কোনোভাবে বলতে পারলেন, ‘তু-তু-তুই তো প্রায় দিগম্বর! এত কম পোশাক কেন?’
‘দেখছিস না, বাসা থেকে সামান্য কিছু পোশাক পরে বাকিটা ধূলি-বসন দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি! কয়েক মিনিট হাঁটলেই ম্যাজিকের মতো পোশাক পরা হয়ে যায়।’
‘তবে বুদ্ধিটা ভালোই। কাপড়ের দোকানে বাকি বাড়বে না।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বন্ধু। জামাল উদ্দিন আবিষ্কার করেন, কিছুক্ষণ আগে আঁচড়কাটা বন্ধুর বুক আবার ভরে উঠেছে ধূলিতে। নিখুঁত ফ্যাশন। বলে না দিলে বোঝার সাধ্য নেই, পোশাকে সুতার ব্যবহার নেই!
পাঁচ.
চারদিকে ধূলির অন্ধকার। অনভিজ্ঞ কেউ দেখে ভাববে, সন্ধ্যা নামছে! জামাল উদ্দিন বসে আছেন বাসে। কন্ডাক্টর যতবার এসে ভাড়া চেয়েছে প্রতিবারই দিয়েছেন। নামার সময় আবার চাইল। টাকা দিতে দিতে জামাল উদ্দিন বললেন, ‘এতবার ভাড়া নিস কেন? এই নিয়ে দশবার নিলি।’
‘অভ্যাস হয়া গেছে। তয় আপনে এতবার দিলেন ক্যান?’
‘খুশিতে রে, খুশিতে। তোকে টাকা ফেরত দিতে হবে না। আমার অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। নিত্যদিন খাচ্ছি দুর্গন্ধময় পানি, খাদ্য নামের বিষ, ঘরে-বাইরে কত অনাচার সইছি। চামড়া হয়ে গেছে গন্ডারের! তবুও বেঁচে আছি দিব্যি!’
কন্ডাক্টরের মুখে বিগলিত হাসি- ‘ছার, আপনের মতন বালা যাত্রী কোনোদিন পাই নাই। খাড়ান, আপনেরে একটা ফুল উপহার দিই।’
ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা ছিল কাছেই। সানন্দে লাল গোলাপটি গ্রহণ করলেন। বাসটি বিদায় নেওয়ার সময় ভুস করে কালো ধোঁয়া ছাড়ল। তাতে গোলাপটি সঙ্গদোষে কালো রং ধারণ করল। প্রথমে মন খারাপ হলেও পরক্ষণেই প্রফুল্ল বোধ করলেন জামাল উদ্দিন। দুর্লভ কালো গোলাপ বলে জলিকে উপহার দেওয়া যাবে। বিশেষভাবে বশরানগরী থেকে আনানো হয়েছে!
