রম্যগল্প
তিন হাজার সনে একদিন
জান্নাতুল ফেরদৌস লাবণ্য
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমার ছেলে রনিকে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছি। ছয় মাসের একটা কোর্স। এরই মধ্যে আশা করা যায় সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার শিখে আসবে সে। এই কোর্সে ফেসবুকে কোন পোস্টে কোন রিঅ্যাক্ট দিতে হয়- এগুলোও শেখানো হয়। আজকালকার জামানায় এগুলো খুব দরকার। যখন বিয়ে হবে কনেপক্ষ ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কম, বরং সোশ্যাল মিডিয়াতে ছেলে কেমন অ্যাকটিভ, তার ফ্যান-ফলোয়ার কেমন- এগুলোই দেখবে।
আমাদের জামানায় এসব ছিল না। যার ফলে আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার জামাই শফিকের বিরাট বড় বাড়ি, ভালো চাকরি, ভালো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে আমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা-মা। কিন্তু বিয়ের পর দেখলাম, ছেলে স্যাড পোস্টে হা হা রিঅ্যাক্ট দেয়! আর ফানি পোস্টে দেয় স্যাড রিঅ্যাক্ট! আমার প্রোফাইল পিকচারে হা হা দেওয়ার পর তাকে আমি ব্লক দিয়ে দিয়েছি, আর খুলিনি। সে এতটা আনস্মার্ট যে তাকে আমাদের ফেসবুক ফ্যামিলি গ্রুপে অ্যাড করতেও লজ্জা লাগে।
আমার বড় মেয়ে তানহাও একই ভুল করেছে। বোকার মতো এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছে। পরে দেখা গেল সেই ছেলের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত নেই! মেয়েরে সেই যে ত্যাজ্য করেছি আর তার মুখ দেখিনি! শুনেছি সংসারের চাপে পড়ে সে এখন আর ফেসবুকেও তেমন একটা অ্যাকটিভ না। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! কী লজ্জার কথা!
থাকার মধ্যে এখন আমার শুধু রনিই আছে। সেই রনিও একটু কেমন যেন। টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম; কিন্তু চালাতে পারে না। লজ্জায় কারো কাছে এই কথা বলিনি যে, আমার ছেলে টুইটার চালাতে পারে না। আসলে রক্তের দোষ! ওর বাপ এক অশিক্ষিত মূর্খ! ছেলেমেয়ে সব সেই ধাত পেয়েছে।
রনিকে এজন্য একটা কোর্সে ঢুকিয়ে দিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার শিখবে। এ যুগে সোশ্যাল হতে গেলে আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে অ্যাকটিভ হতে হয়। আমাকেই দেখুন! স্বামী, সংসার, বাচ্চা সামলেও ফেসবুকে বিশ হাজার ফলোয়ার। ইনস্টাতে অ্যাকটিভ, টুইটারে অ্যাকটিভ, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো সবকিছুতেই দিনের মধ্যে একবার না গেলে শান্তি লাগে না। ছেলেমেয়েগুলো আমার ধারা কিছুই পেলো না! আফসোস!
বাসায় ঢোকার পথে পাশের বাসার সারার সঙ্গে দেখা। এই মেয়েটা খুব স্মার্ট। টিকটক সেলিব্রিটি। সারা আমাকে দেখে মুচকি হেসে মেসেঞ্জারে ওয়েভ পাঠালো। আমিও ওয়েভ ব্যাক দিলাম। খানিকক্ষণ চ্যাটিং করে খোঁজখবর নিলাম ও কেমন আছে, বাসার সবাই কেমন আছে। সারা জানালো ওর আম্মু একটু অসুস্থ। ইউটিউব দেখে একটা রেসিপি করেছিল সেটা খেয়ে বদহজম হয়েছে, ঘরেই আছে।
খোঁজখবর নেওয়া উচিত! তাই সারার আম্মুকে মেসেঞ্জারে নক দিলাম। গেট ওয়েল সুন কার্ড পাঠিয়ে একটু খোঁজখবর নিয়ে দুপুরের খাবার অর্ডার দিলাম একটি অনলাইন ফুড শপে। এদের সার্ভিসও আজকাল একটু ঢিলা হয়ে গেছে!
রনির আব্বু বসে বসে টিভিতে খবর দেখছিল। দেখেই মেজাজটা সপ্তমে উঠে গেল। এই লোকটা এত বোকা কেন খবর দেখতে টিভি দেখা লাগে? ইউটিউব আছে কেন তাইলে? এই লোকটাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেল, তবু স্মার্ট করতে পারলাম না!
রনির আব্বু বলল, ‘খাবার-দাবার কিছু করো ক্ষিদা লাগছে।’
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, ‘অনলাইনে অর্ডার দিয়েছি। চলে আসবে, অপেক্ষা করো।’
‘ঘরের কী অবস্থা দেখেছ? পরিষ্কার করো না কেন?’
‘নিট এন্ড ক্লিন সার্ভিসকে ফোন দাও, পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে। আর তুমি বসে বসে টিভি দেখবা না। যাও, ইউটিউবে খবর দেখো গিয়ে। ছেলেমেয়েদের সামনে আর দেখাতে যেও না তুমি কতটা ক্ষ্যাত!’
রনির আব্বু বিরক্ত মুখে উঠে গেল। তবে ইউটিউব নিয়ে বসল না। জামা-কাপড় পাল্টে পানির বিলের কাগজ নিয়ে বিল দিতে বেরিয়ে গেল।
এই দুপুর রোদে পুড়ে কেউ পানির বিল দিতে যায় এ যুগে? মোবাইল আছে কী করতে! রাগে-দুঃখে-কষ্টে তাকে আর না আটকে বাকরুদ্ধ হয়ে ঘরে বসে রইলাম। এমন একটা লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে বাপ-মা। জীবনে টাকা-পয়সাই সব না। আমাকে একটা গরিব ঘরের ফেসবুক সেলিব্রিটির সঙ্গেই না হয় বিয়ে দিত! ছেলের ঘরে আর কিছু না থাক, ওয়াইফাই লাইন থাকত। আর কিছু না হোক, ছেলে ফানি পোস্টে হা হা দিতো আর প্রোফাইল পিকে কমেন্ট করত gorgeous! কিন্তু এত সুখ কি আর আমার কপালে আছে?
আমি ঠিক করে ফেললাম রনির জন্য একটা সেলিব্রিটি মেয়ে আনব। মেয়ে গরিব হোক, কিন্তু তার সোশ্যাল প্রোফাইল ঝকঝকে হওয়া চাই। সারা মেয়েটা মন্দ না। তবে শোনা যাচ্ছে টিকটক ব্যান হয়ে যেতে পারে। যদি যায় তাহলে সারাকে বউ করার রিস্ক নেওয়া
যাবে না।
আমি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্ট দেখে সেলিব্রিটি টাইপ কয়টা মেয়ের আইডি স্ক্রিনশুট নিয়ে রাখলাম। তাছাড়া আজকাল ফেসবুকেও কিছু ‘নিজ এলাকার পাত্রী খুঁজুন’ টাইপের গ্রুপ বের হয়েছে, ওখানেও পোস্ট দিয়ে দেখা যেতে পারে। আজই দেখতে হবে। কয়টা মেয়ের শর্ট লিস্ট করে রনি এলে দেখাব। যাকে ওর পছন্দ হয় ভিডিও কলে মেয়ে দেখিয়ে দেবো। তার আগে অবশ্যই টুইটারে অ্যাকটিভ করতে হবে ওকে। আমার জীবনটা যেভাবে নষ্ট হয়েছে রনির তা হতে দেওয়া যাবে না।
