|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনা উপদ্রুত বাংলাদেশে প্রায় চলেই এসেছে বাংলা নববর্ষ! গত বছরের পহেলা বৈশাখের উৎসবটা মার খেয়েছিল লকডাউনের মাইনকার চিপায় পড়ে। না খাওয়া হলো পান্তা-ইলিশ, না শোনা হলো একদিন বাঙালি ছিলাম গানটা! এবারকার উৎসবটাও হুমকিতে পড়েছে। বিরক্তিতে ভ্রূ কোঁচকায় বিপুল। ফেস্টিভ্যালে যদি এনজয় করা না যায়- জীবন একেবারেই বোরিং হয়ে পড়ে। অনেক ভাবনা ও আশঙ্কার পর নতুন একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করল সে। এবারকার ফার্স্ট বৈশাখ ফেস্টিভ্যাল উদযাপন করতে হবে একটু অন্যভাবে।
মাঝে মাত্র তিনটি দিন। শনিবার প্রত্যুষেই রাস্তায় নামল সে। সাধারণ মানুষের ভাবনা জানার মধ্য দিয়ে পেয়ে যেতে পারে পিএইচডির রসদ। রাস্তাঘাট এখনো ফাঁকা। সকালের আলো আরেকটু পরিষ্কার হলে দেখা দিল এক তরুণ। স্বাস্থ্যসচেতন, মর্নিং ওয়াকে এসেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করল বিপুল, ‘একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জরিপ করছি আমরা। বঙ্গাব্দ শুরু হবে আগামী বুধবার থেকে। আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই, ব বর্ণ দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত শব্দটি।’
‘স্যরি ম্যান! বুঝতে পারলাম না।’
‘ধরুন- অ-তে অক্ষর, আ-তে আগরতলা, ই-তে ইংলিশ; এভাবে ব-তে...।’
‘ব-তে বারুদ হয় আবার বউও হয়। আমার কাছে দুটোই সমান!’
‘বউও কি বারুদের মতো বিস্ফোরক?’
‘নয়তো কী? আপনি ভাবছেন, আমি মুক্ত বাতাস গায়ে লাগাতে এসেছি! কস্মিনকালেও নয়। যতক্ষণ বাইরে থাকি মনে হয়, বেঁচে আছি!’
অন্যের বউয়ের বদনাম শুনে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। নিরাপদ দূরত্বে সরে আসে বিপুল। এক খোকাবাবু ইয়ার ফোন লাগিয়ে হাঁটছে। নিশ্চয়ই গান শুনছে- এসো হে বৈশাখ এসো এসো...। বিপুল তাকে প্রশ্ন করে, ‘বাবু, বলো তো আজ চৈত্র মাসের কয় তারিখ?’
‘সেটা আমি বলতে পারবো না। তবে টেলিভিশনে বৈশাখের নাটকের বিজ্ঞাপন দেখেছি। ক’দিন বাদেই যেন নববর্ষ!’
‘বৈশাখ শুরু হয় কোন সময় থেকে?’
‘এটা কে না জানে; মধ্য এপ্রিল থেকে! তার আগে-পরে আসে বাজারে কাঁচা আম আসে!
‘নতুন যে বছর শুরু, সেটা কত সাল?’
‘ইংরেজি ক্যালেন্ডারের পাতায় নিশ্চয়ই ছোট অক্ষরে লেখা থাকবে। দেখে নেব। তবে ওটা কারও কাজে আসে না!’
সাজুগুজু করা এক তরুণীতে দেখে প্রশ্ন করে বিপুল, ‘আপুর বেশভূষায় মনে হচ্ছে, কোনো বৈশাখী প্রোগ্রামের নাচের রিহার্সালে যাচ্ছেন?’
‘আমি নাচি না, নাচাই।’
‘কাদের নাচান?’
‘বদরুল, বশির, বনি, বকর, বাতেন...।’
‘তারা নিশ্চয়ই ভালো শিক্ষার্থী। আগামীতে বড় নৃত্য শিল্পী হবে!’
‘আরে ধুর! আমার পেছনে ওরা লাইন দেয়। ওসব ছ্যাবলামি পাত্তাই দিই না।’
‘বাহ, আপনি মানসিকভাবে বেশ শক্ত-পোক্ত। আসন্ন বৈশাখের প্রাসঙ্গিক ব আদ্যক্ষরের একটি নাম শুনতে চাই...।’
‘আপনি শুনতে চাচ্ছেন Boishakh means নব-বঙ্গাব্দের প্রথম মাসের নাম। কিন্তু সেটা বলব না। ব-তে বদ। চারপাশে অসংখ্য বদ, মনে হচ্ছে আপনিও তাদেরই একজন।’
‘গবেষক আমি, বদ বা কারো বশংবদ নই!’
‘শিশু শিক্ষার আদলে গবেষণা হয় না। গ-তে গরু বলে মামুলি বিষয়টাও বুঝতে পারছেন না। কিংবা বুঝে-শুনেই আমার মতো সুন্দরী মেয়েদের জ্বালাতন করছেন।’
ততক্ষণে আপার চারপাশে ভিড় জমিয়েছে মজনু-কুল। এরা সবাই বোধহয় ব বর্গীয়। সম্মান ও পিঠ বাঁচাতে সটকে পড়ল বিপুল। নিজেও যে আরেকটা ব; আপা জেনে ফেললে ঝামেলা পাকাতে পারে। এর চেয়ে বয়স্ক কোনো মানুষের সঙ্গেই আলাপ জমানো ভালো। বাছাইও করল একজনকে, ‘মুরব্বি, বলুন তো ব-তে কী হয়?’
‘প্রকৃত অর্থে ব-তে বন্দি। এটাই সর্বজনগ্রাহ্য। পৃথিবীতে অদৃষ্টের ফেরে বন্দি কে নয়? কেউ জেলখানায়, কেউ সংসার বা চাকরির যাঁতাকলে, আবার কেউ বন্দি করোনাতঙ্কে।’
‘মনে হচ্ছে, আপনি নামকরা কোনো দার্শনিক!’
‘সঠিক উপলব্ধি। আমি ফকির পাড়া দার্শনিক সংঘের সভাপতি। সম্রাট আকবরের নাম শুনেছ? খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য যিনি বৈশাখে হালখাতার প্রচলন ঘটিয়ে...।’
‘সম্রাট আমার খালাতো ভাই, আর আকবর পাড়াতো বন্ধু। এর বাইরে আর কাউকে চিনি না।’
‘বেকুব তুমি; ইতিহাস জানো না।’
‘সবকিছু জানতে নেই। এবার আমাকে মুক্তি দিন!’
দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। আসন্ন নববর্ষে ঐতিহ্যময় হালখাতা সম্বন্ধে ব্যবসায়ীদের ভাবনা জানা দরকার। এক দোকানদার গভীর মনোযোগে ক্যাশবাক্স মুছছেন। এগিয়ে গিয়ে বিপুল বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই ব বলতে বউনি বোঝেন?’
‘ওইদিন রিকশা ভাড়া দেওয়ার জন্য বিশ টাকা নিয়েছিলি। একটু পরে আসবি বলে লাপাত্তা! এখন টাকা দে। বউনিটা করি তোকে দিয়েই!’
বিপুল বোঝানোর চেষ্টা করল- সে কখনই ধার-কর্জ করেনি, রিকশায়ও চড়ে না। কিন্তু দোকানি শুনলে তো! শেষমেশ বিশ টাকা জরিমানা দিয়েই নিষ্কৃতি পেতে হলো। বিদায়ী বছরের অন্তিমকালে এমন নৃশংস অপমান! না জানি আগামী বছরটায় কী আছে কপালে!
বৈশাখ মাসের ইংরেজি প্রতিশব্দ কী- প্রশ্নটি মাথায় ভর করায় বিপুল এবার কল দেয় তার পরিচিত এক বিজ্ঞ অধ্যাপককে। ওপাশ থেকে জবাব আসে, ‘অতীব জরুরি একটা প্রশ্ন করেছ। ডিকশনারি দেখে আমি এখনি জানাচ্ছি। লাইন কেটো না!’
