আহা পেঁয়াজ! আহারে পেঁয়াজ!
সত্যজিৎ বিশ্বাস
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অভিজ্ঞ বাজারু জামান সাহেব কাঁচাবাজারে ঢুকেই বুঝলেন পেঁয়াজের ঝাঁজে পরিস্থিতি আর পরীতে স্থিতি নেই, পেতনিস্থিতি চলছে চারপাশে। সতর্ক দাবাড়ুর দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ বাজার পর্যবেক্ষণের পর ঢুকলেন হাসমতের দোকানে। যেভাবে দাবার ঘুঁটি তোলে সেভাবে একটা পেঁয়াজ হাতে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিরে, পেঁয়াজের হালি কত?’
মুদি দোকানদার হাসমত বিরস কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘একদাম বিশ টাকা।’ উত্তর শুনে জামান সাহেব যেই না বিড়বিড় করে বললেন, ‘ঘুঁটিবাজটা বলে কী?’ অমনি হাসমত ভ্রু কুঁচকে তাকাল, ‘আমারে কিছু কইলেন চাচা?’
জামান সাহেব পেঁয়াজের দাম বাড়ার গুপ্ত খবর জানতে ঘোড়ার চাল দিলেন এবার, ‘বললাম, হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম এমন হুড়হুড় করে বাড়ছে কেন রে?’
‘ও, এই কথা? পাইকাররা কয়, এই সময়ে ভারত থেইকা পেঁয়াজ আসা বন্ধ দেইখা দাম বাড়ে। আর আড়তদাররা কয়, যেইসব জেলায় পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি হয়, সেইসব এলাকার হাটে এখন বেশি দামে বিক্রি হইতাছে, তাই বাজারে দাম বাড়ছে। তয় চাচা, আসল ঘটনা কিন্তু দুইডার একটাও না।’
‘বলিস কীরে? আসল ঘটনা তাইলে কী?’
‘আসল ঘটনা হইল ঝাঁজ। যার ঝাঁজ আছে, তার দাম আছে। আর যার দাম আছে, দাম তো তারই বাড়ব, ঠিক কীনা কন?’
হাসমতের মতকে পাশ কাটিয়ে জামান সাহেব নিজের মতাদর্শে চলে গেলেন অতিদ্রুত, ‘চিন্তা কর ব্যাপারটা, বেশিদিন আগের কথা না, যখন এক কেজি পেঁয়াজ পাওয়া যেত এক টাকায়। তাজা তাজা মাছ বাজারে আসার পর লাফাত। সেই লাফানো দেখে মাছ কিনতাম। আর এখন? কয় বছর আগের মরা মাছের সামনে মানুষ লাফায়। দরাদরি করে কে আগে কিনবে, সেই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত সবাই। আগে রাস্তার ধারে কচুশাক পড়ে থাকত, কেউ তুলে নিয়ে বাজারে বিক্রির জন্য আনত না। আর এখন কচু শাকের দাম শুনলে মনে হয়, কচু গাছে ফাঁস লাগিয়ে মরি। সবজির বাজারে আগুন জ্বলছে তো জ্বলছেই। একটু পর পর দুই লিটারের প্লাস্টিকের বোতলে বোতলে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভায় সবজিওয়ালারা। দিনদিন কীভাবে জিনিসের দাম শুধু বেড়েই চলেছে, খেয়াল করেছিস?’
‘হুম’
‘হুম মানে কী?’
‘জিনিসের দাম বাড়তাছে।’
‘তুই কী জানিস, ষাট সালের দিকে ডালের দর কত ছিল?’
‘কত?’
‘চার আনা সের।’
‘কন কী, তখনো ডাইল ছিল?’
‘থাকবে না কেন? মুগ ডাল, মুসুরির ডাল, মাষকলাইয়ের ডাল, বুটের ডাল, অরহরের ডাল, মটরের ডাল, খেসারির ডাল।’
‘ও আইচ্ছা, আমি অবশ্য অন্য ডাইলের কথা ভাবছিলাম। যাউক গা, কী যেন কইতেছিলেন?’
‘বলছিলাম, তখনকার দামের কথা। তখন কত অল্প টাকায় কত কিছু কেনা যেত, জানিস?’
‘জাইন্যা কী করুম?’
‘তা জানবি কেন? পড়ালেখা কিছু করেছিস? করিস নাই। করলে তো জানবি। শোন, পড়ালেখা ছাড়া জীবন অচল।’
‘কী যে কন চাচা। আমি তো দেখি উল্টা। মালামাল বেইচাই কূল করতে পারি না। আর এদিকে পড়ালেখা জানা মাইয়া, পোলারা লাইন দিয়া খাড়াইয়া থাকে আমার দোকানে। কী কী মাল লাগব, সেই মালের সাপ্লাই দেওনের লাইগা। এখন আপনেই কন, এত জাইন্যা করুম কী?’
‘জেনে কী করবি মানে?’
‘কোন জিনিসের কত দাম ছিল, জানলে কী জিনিসের দাম কমব? তাইলে এক্কেবারে শেরশাহ-এর আমল থিক্কা শুরু করেন।’
‘ফাজলামি করিস? এভাবে হু হু করে দাম বাড়লে চলবে?’
‘জ্বি চাচা, চলব। শুধু চলব না, ভনভনাইয়া দৌড়াইব। দেখতাছেন না, মানুষ লাইন ধইরা কিনতাছে। এই যে পেঁয়াইজের যত দাম বাড়তাছে, তত বেশি মাইনসে কিনতাছে। বন্ধ হইছে কেনা?’
অভিজ্ঞ বাজারু জামান সাহেব হিসাব মেলাতে পারছেন না। অনেক চেষ্টা করেও না। অর্থনীতির চাহিদাবিধির সূত্রানুসারে, দাম বাড়লে তো চাহিদা কমার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ‘অর্থনীতি’ অশিক্ষিত হাসমতের মতের দাম দিলো কেন কে জানে? যতই দাম বাড়ছে মানুষ হুড়মুড় করে উপচে পড়ছে হাসমতের দোকানে। ঘটনা কী?
