রম্যগল্প
ভালোবাসা ওভারলোড
জান্নাতুল ফেরদৌস লাবণ্য
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিয়ে হয়েছে পর্যন্ত উৎসের আচার-আচরণ আমার কাছে মেয়ে মেয়ে লাগে। মনে হয় আমাদের সম্পর্কে আমি ছেলে আর ও মেয়ে। মেয়ে বলতে আমি বোঝাচ্ছি যেসব কাজ বিয়ের পর সত্তরভাগ বাঙালি মেয়েরা করে, উৎস সেই জাতীয় আচরণ করে আমার সঙ্গে। যেমন সারাক্ষণ আমার দিকে নজর রাখা। হুটহাট বলে ওঠা, আমি পুরোনো হয়ে গেছি তো এজন্য আমাকে আগের মতো ভালো লাগে না! ইত্যাদি আরও অনেক কিছু।
মাঝেমধ্যে আমি ওর আচরণে বিরক্ত হয়ে বলি, ‘এগুলো তো আমার বলার কথা! আমি তো বলি না, তুমি এসব বলো কেন?’
তাতেও উৎস মুখ গোমড়া করে বলে, ‘হ্যাঁ! এখন তো আমার কথা ভালো লাগবেই না! বিয়ের আগে এই কথা বললেই মধুর মতো মিষ্টি লাগত তোমার।’
উৎসের কথায় বিরক্ত হয়ে আলাদা ঘরে গিয়ে ঘুমাই। তারপর মাঝরাতে দেখি দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে আমি কারও সঙ্গে চ্যাটিং করছি কিনা।
আমি অনেক ভেবেছি, তারপরও বের করতে পারিনি উৎসের এ মেয়েলি আচরণের পেছনে সায়েন্সটা কী! ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর কথাও ভাবছি। ওর এসব আচরণ আমার স্বাভাবিক লাগে না।
প্রতিদিনই অফিস থেকেও সকাল সকাল চলে আসে। কোনো বন্ধুর সঙ্গে কোথাও আড্ডা দেওয়া, লেট করা-এসব করে না। একবার এক বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে আমাকে নিয়ে উপস্থিত। সেজেগুজে সেখানে গিয়ে এক ভয়াবহ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। বয়েজ পার্টি। সব ছেলে ইনভাইটেট, কেউ বউ নিয়ে আসেনি। কিন্তু উৎস আমাকে ছাড়া একা কোথাও যাবে না।
সেদিন বাসায় এসে ওকে অনেক গালাগালি করার পর বললাম, ‘আমার থেকে দূরে থাকবা। বিয়ের এত বছর পর বউয়ের থেকে দূরে সরে যেতে হয়। এনিভার্সারি, বউয়ের জন্মদিন ভুলে যেতে হয়, বন্ধুদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে হয়, পারলে অন্য মেয়েদের সঙ্গে টুকটাক গল্পও করতে হয়। সব সময় আমার ল্যাজে ল্যাজে ঘোরো কেন?’
এতে উৎস কাঁদো কাঁদো হয়ে আমাকে যা শোনাল তার সারমর্ম হচ্ছে, ওর মতো বর মেয়েরা চেয়েও পায় না। সব মেয়ের স্বপ্ন থাকে তার স্বামী তার আগে-পিছে ঘুরবে, ভালোবাসবে। বিয়ের অনেক বছর পরও তাদের ভালোবাসা ফিকে হবে না। আর আমি এরকম সোনার টুকরো স্বামী পেয়েও তার মূল্য বুঝছি না!
আমিও রাগের মাথায় বলে ফেললাম, ‘মূল্য বুঝবটা কী করে? যে স্বামী দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা লেজে লেজে ঘুরে তার মূল্য কোনো মেয়েই বুঝবে না। তুমি বরং আমার থেকে দূরে থাকো, আমি দেখি চেষ্টা করে তোমার অভাববোধ করতে পারি কিনা। কবি বলেছেন, কষ্ট বিনা সুখের মূল্য কেউ বোঝে না। দয়া করে আমাকে কষ্ট দাও, দূরে সরে যাও।’
এই কথাই কাল হলো। বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে উৎস বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমি গা করলাম না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও ফিরে আসবে। যাবে কই? বন্ধুর বাড়িটাড়ি গিয়ে বেশি সময় থাকতে পারবে না। আমাকে ছাড়া খুব বেশিক্ষণ থাকার অভ্যাস ওর নেই।
কিন্তু একসপ্তাহ হয়ে গেল ওর কোনো খোঁজ নেই। ফোন দিলেও ধরে না। না পেরে শেষে ওর বন্ধুবান্ধবদের ফোন দেওয়া শুরু করলাম। অফিসে ফোন দিলাম। সবাই বলে, ও কোথায় তা তো আপনারই ভালো জানার কথা! আপনি যেখানে ওর সেখানেই থাকার কথা!
চিন্তায় অস্থির আমি পুলিশে যাব বলে স্থির করলাম। পুলিশ নাম্বার ট্র্যাকিং করে-টরে যদি বের করতে পারে। পুলিশের কাছে যাওয়ার দরকার পড়ল না। তার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি উৎস খালি একটা বাটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে গম্ভীর গলায় বলল, ‘একটু চিনি হবে?’
হতবাক আমি বিস্ময় মাখা গলায় বললাম, ‘তুমি কোত্থেকে?’
উৎস আগের মতোই গম্ভীর গলায় বলল, ‘পাশের ফ্ল্যাট থেকে। চিরকুমার সিদ্দিক সাহেবের সঙ্গে রুম শেয়ার করছি।’
তখনকার মতো নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘পাগলামি বাদ দিয়ে বাসায় আসো।’
উৎস উৎসাহী গলায় বলল, ‘কেন? অভাববোধ করছ? না করলে আরও কিছুদিন সময় নাও। আমার কোনো সমস্যা নেই। এমনিতেও দুরবিন ফিট করে তোমাকে দিনরাত দেখছি।’
তারপরই গম্ভীর গলায় বলল, ‘তাছাড়া তুমি বললেই তো আর আমি ঘরে ফিরে আসতে পারি না। ছেলে মানুষ দিনের পর দিন বউকে ছেড়ে বাড়ির বাইরে থাকতে পারে। আমিও থাকব।’
আমার মুখে কোনো কথা এলো না। এলে বলতাম, ‘তারা পাশের ফ্ল্যাটে বসে দুরবিন দিয়ে বউকে দেখে না!’
