Logo
Logo
×

বিচ্ছু

চাপা হাসি কাঁপা কাশি

Icon

শফিক হাসান

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চাইলেও কালিগোলা অন্ধকার নাম ধারণ করতে পারত না শিউলিমালা খন্দকার; স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তার নাম সুহাসিনী হওয়াই সঙ্গত ছিল। কিন্তু নামের সঙ্গে কাজের সমন্বয় পৃথিবীতে কয়টা ঘটে!

শিউলিমালা জানে, তার মতো হাসি-সমস্যাগ্রস্ত মানুষ পৃথিবীতে আরও নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তারাও এ ধরনের বিপদে পড়ে! চিকিৎসক, পরামর্শক থেকে দার্শনিক সবাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেন-হাসি স্বাস্থ্যের জন্য উপাদেয়। কিন্তু এ হাসি-খুশি থাকাই শিউলিমালাকে বিপদে ফেলে বারবার। সুন্দর হাসিই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড় শত্রু! ওর মুখটা সব সময়ই হাসি-হাসি থাকে। এমনকি চরম দুঃখের সময়-শোকাবহ মৃত্যুর দিনেও!

অপরিচিত মানুষরাও যখন দেখে, তাদের দিকে হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে শিউলিমালা, তারা ধন্ধে পড়ে যায়। তখন অপরপক্ষও কুশলাদি বিনিময় করতে আসে। এমন ধোঁয়াশাপূর্ণ আবহে শিউলিমালার লাভ ছাড়া লোকসান হয় না। কিন্তু কখনোসখনো ‘সুহাসিনী’ মুখই অপবাদ ডেকে আনে। কিছুদিন আগে বাবার একজন সহকর্মী খোঁজ নিতে এলেন। ঠিকানা নিশ্চিত হয়ে বললেন, ‘মালেক সাহেবকে একটু ডেকে দাও।’

শিউলিমালা জবাব দিল, ‘বাবা খুব অসুস্থ। শয্যাশায়ী। উঠতে-বসতে পারেন না।’

শোনামাত্রাই চেহারা বদেল গেল তার। চেঁচিয়ে বললেন, ‘বাবা অসুস্থ, এটা আনন্দের বিষয়? মজা করে খারাপ খবর কীভাবে দাও?’

‘আসলে আঙ্কেল...।’

‘নিকটাত্মীয় কেউ মারা গেলেও এভাবেই খুশির খবর জানাও। এটাই তো আসল কথা?’

শিউলিমালাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই ক্রোধান্বিত চলে যান।

কিছুদিন আগে বিদেশফেরত খালাতো ভাই শিউলিদের বাসায় পা দিয়েই বললেন, ‘বাবা আর নেই।’

‘কীভাবে মারা গেলেন খালুজান?’

হাসি-হাসি মুখ দেখে তব্দা মেরে গেলেন খালাতো ভাই। পরিস্থিতি অনুধাবন করে শিউলির মা তড়িঘড়ি বললন, ‘তোকে না বলেছি, বাইরের মানুষের সঙ্গে বেশি কথা বলবি না!’

‘ও, আমি তাহলে বাইরের মানুষ?’ বলে খালাতো ভাই আর দাঁড়ালেন না। মা শিউলিমালাকে গালমন্দ করলেন বটে, কিন্তু সর্বনাশ যা ঘটার ঘটে গেছে!

দুই.

স্কুল-কলেজেও নানাভাবে শিউলিমালাকে বিব্রত করেছে এ হাসিমুখ। স্কুলে একবার ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। ভিখারিনী সেজে স্যারদের কাছে ভিক্ষা চাওয়াই ছিল তার খেলা। কিন্তু হাসি-হাসি মুখ করে ভিক্ষা চাওয়া দেখে স্যাররা রেগে গেলেন। খোদ হেডস্যার রাগ করে বললেন, ‘এভাবে কেউ ভিক্ষা দেয়! ভিক্ষা চাইতে হয় নিজের ছোট সমস্যাকে প্রকট করে দেখিয়ে। মানুষ পছন্দ করে ভিখারির দুঃখী-দুঃখী এক্সপ্রেশন।’ সেই প্রতিযোগিতায় দুইটা টাকাও ভিক্ষা পায়নি, উপরন্তু তৃতীয় হওয়ার খেতাবও হাতছাড়া হয়েছে। শুনে বাবা বলেছিলেন, ‘বিস্কুট খেলায় নাম দিলি না কেন?’

মা বিরক্ত হয়ে ধাতানি দিয়েছিলেন বাবাকে, ‘ও হাসবে নাকি বিস্কুট খাবে!’

এমন ঘটনা কলেজেও ঘটেছে। দুর্ঘটনায় মারা গেছেন একজন শিক্ষক। তার স্মরণে মিলাদ-মাহফিলের আয়োজনে শিউলির অবস্থা দেখে একজন ম্যাডাম বলে উঠলেন, ‘অ্যাই মেয়ে, মনে হচ্ছে তুমি খুব আনন্দে আছ! স্যারের সঙ্গে কী শত্রুতা ছিল তোমার?’

শিউলি জবাব দেয়নি। এতদিনে জেনে গেছে, এসব ক্ষেত্রে হিতে বিপরীতই হয়।

এভাবে পদে পদে বিপদে পড়তে থাকলে কীভাবে বাঁচে মানুষ! ওর বিপদ উপলব্ধি করে একজন পরামর্শ দিল, নিয়মিত মাস্ক পরিধান করতে। তাহলে হাসিমুখ দেখবে না কেউ। কিন্তু ‘খুশি’তে যার চোখের তারা নাচে, সে মুখ আড়াল করলে লাভটা কী! সমস্যার মাত্রা আরেকটু বেড়েছে। আহ্লাদি মেয়ের মতো যে কোনো কথা কথায় টেনে-টেনে বলতে শুরু করল শিউলিমালা, ‘ও-মা, তাই!’

অবস্থা এমন দাঁড়াল, তুচ্ছ কথায়ও শিউলি হেসে গড়িয়ে পড়ে। মাস্ক লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করল! অবশ্য মাস্ক খুলে ফেললে এমন ‘ক্রনিক হাসনি’ রোগটা থাকে না। মানসম্মান বাঁচাতে বাবা ওকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। সব শুনে বিরক্ত চিকিৎসক বললেন, ‘আমাদের কাজ কারও হাসি কেড়ে নেওয়া নয়। হাসি ফিরিয়ে দেওয়া!’

কৌশল হিসেবে হাঁচি-কাশি দিয়েও ভয়ংকর হাসি আড়াল করতে পারছিল না শিউলিমালা। সব ব্যবস্থাপত্রই অকৃতকার্য হয়ে যায়। চিকিৎসাহীনতার শেষকালে জানল আচানক একটি বিষয়। আরও লাখো দিবসের মতো আন্তর্জাতিক হাসি দিবসও আছে! ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে- বেশি হাসলে কাঁদতে হয়। অথচ এই ‘হাসি দিবসে’ কিনা স্বদেশি আয়োজকরা হাসি প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। খুঁজে বের করবেন-কার হাসিটা হৃদয়কাড়া! তাদের স্লোগান-‘চল হাসি, পৃথিবী বদলাই’।

প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার প্রস্তাব এলে শিউলিমালা মুখ কালো করে বলল, ‘তার আগে নিজেকে বদলাই!’

ওর ‘কালোমুখ’ দেখে লোকজন হাসিই থামাতে পারে না। শিউলিমালারও ‘বদনখানি মলিন’ হয়-কারও বিশ্বাসই হয় না! সবার এত অবিশ্বাস দেখে এক সময় শিউলিমালা খন্দকারও অন্ধকার দূর করে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে!

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম