মলাট বৃত্তান্ত
গনি মিয়ার বাজেট জ্ঞান
জীবনাচারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে গনি মিয়ার। লোকজন এখনো অতীত আঁকড়ে থেকে উলটাপালটা বকতে ভোলে না। গনি মিয়া নাকি একজন গরিব কৃষক, তার নিজের জমি নেই, অন্যের জমি চাষ করে...। দেশে বাজেট এলে সঙ্গে আনে জুন মাসের গরম; তখনই লোকজন উলটাপালটা আচরণ শুরু করে।
গনি মিয়ারা আজীবন বোকা থাকে না, ঠোকর খেতে খেতে একসময় ঠিকই চালাক হয়ে যায়। সে দেখেছে, যে পরিমাণ টাকা দিয়ে চাষাবাদ করে অনেক সময় মূলধনই ওঠে না। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যদি এমন টানাহ্যাঁচড়ায় পড়তে হয়, কেন ঘানি টানতে হবে! গ্রামের মানুষ কত্ত বোকা! চিন্তায় চিন্তায় গনির মন অস্থির হয়ে উঠেছিল। অস্থিরতা বিরাজমান থাকতেই নিজের সব ‘জমিদার’কে গুডবাই জানিয়ে ঢাকায় এসে থিতু হয়েছে।
এ উলটাপালটা ঢাকায় অনেক মানুষ ফাঁকা আওয়াজ দেয়, এরা কেউই না খেয়ে থাকে না। বিভিন্ন পয়েন্টে মাজার থাকায় শিরনি-খিচুড়িও মিলে যায় সহজেই। রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলে পাওয়া যায় বিরিয়ানির প্যাকেট, সঙ্গে বোতলজাত পানিও। নগরজীবনের স্বাদ ক্রমান্বয়ে বুঝতে শিখল গনি মিয়া। সময়ে সময়ে পেশা পালটায় সে। ‘বদল’ই নগর জীবনের স্মার্টনেস। যে যত বেশি ‘পল্টি’ দিতে পারবে, সে তত অগ্রসর নাগরিক। ছেলেমেয়েরাও লায়েক হতে শুরু করেছে। আরেকটু বড় হলে এরাই সংসারের হাল ধরবে, পারিবারিক বাজেট প্রণয়ন করবে-গনি থাকবে চিন্তামুক্ত। ছেলেমেয়েরা কোটিপতি হতে শুরু করলে যারা তাকে ‘গরিব কৃষক’ বলে অঙ্ক মুখস্থ করে-সমুচিত জবাব দেওয়া যাবে!
রাজধানী চালাক-চতুর মানুষের জায়গা, এখানে সরল মানুষের ভাত-বার্গার কোনোটাই নেই। জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী একদিন বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দেয় গনিকে। ছেলেমেয়েরাও সাক্ষর, তার ‘অশিক্ষিত’ থাকাটা মানায় না। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষিত হয়েই মাথা ঘুরে যেতে লাগল। গনি মিয়া খেয়াল করল, নিয়ম করে জুনে বাজেট আসে, বাজেট এলে অনেক রকম জিনিসপাতির দাম বাড়ে। সরকার একবার বাড়ালে ব্যবসায়ীরা বাড়াবে তেইশবার। সরকার বিশ টাকা বাড়ালে ব্যবসায়ী বাড়াবে উনসত্তর টাকা। এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ওইসব বাজেট-ফাজেট না দিলে কী হয়! চিন্তার কথাটা একদিন শ্রেণিশিক্ষক মানসুরা রহমানকে জানাল। প্রথমে মানসুরা গম্ভীর হলেন, তারপর স্মিত হেসে বললেন, ‘আরে বোঝো না, বাজেট না দিলে এতকিছু হবে নাকি...?’
‘কতকিছু!’ হা হয়ে যায় গনি মিয়ার মুখ। বিস্ময়ে লকলক করে আলজিব।
মানসুরা স্মিত হেসে বলেন, ‘আরেকটু বড় হও, খুঁটিনাটি বুঝতে পারবে। জানবে, বাজেট কেন আসে। গান শোনোনি-অলি বারবার ফিরে আসে, অলি বারবার ফিরে যায়...?’
অনেক গানই শোনেনি সে, অলি মিয়ার কী সমস্যা তা-ও জানা নেই। নেই মাথাব্যথাও। চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজেট-নাট্য। এটি একইসঙ্গে গণমুখী-গণবিরোধী কীভাবে হয়! বানান করে পড়তে গিয়ে নিজের আরও মিতার সন্ধান পেল সে। গনি মিয়া বানান কী হবে- ন নাকি ণ? দুই রকমেরই দেখা মিলছে। এটা কি বাজেটের মতোই আরেক নৈরাজ্য! ভাবনার কথাটা জানালে মানসুরা ম্যাডাম বললেন, ‘তুমি দেখছি এখন চিন্তাশীল তাত্ত্বিক হয়ে উঠলে! তবু ভালো মিয়া বানানে য় নাকি ঞ শুদ্ধ এমন প্রশ্ন করোনি! আগে ঞ দিয়ে দিয়েই লেখার প্রচলন ছিল। এখনো কেউ কেউ লেখেন!’
‘কিন্তু আপা, আমরা তো শিখেছি ঞ-তে মিঞ! মানে বিলাই। বাজেটেও নাকি কালো বিড়াল আর কালো ব্রিফকেস থাকে?’
এবার বিরক্তই হলেন ম্যাডাম। ঝাড়ি মেরে বললেন, ‘বেশি বুঝতে চেয়ো না। পরে বিপদে পড়বে।’
কম বুঝে কি ঢাকায় চলা যায়! প্রতিবার বাজেটে দ্রব্যমূল্যের অগ্নি-হলকা বয়, আর গনি মিয়া সেসব শক্ত হাতে সামাল দেয়। তার বউ থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েরাও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি কমই! পাড়াপ্রতিবেশীরা প্রশ্ন করলে সহজেই জবাব দেয়, ‘শিক্ষিত মানুষ বেশি খাবে, পরবেও দামি পোশাক; এটাই স্বাভাবিক!’
ফি-দিন শিক্ষিত হয়ে ওঠা গনি মিয়া জানে ও মানে মনীষী-বচন-ঋণ করে হলেও ঘি খাও! ঘি শরীরকে দেয় বল, মাথাকে দেয় বুদ্ধি! ঋণের হাজারও উপকারিতা থাকতে পিছিয়ে থাকার মানে নেই। এখন কিস্তিতেও ঋণ নেওয়া যায়, সুদেও পাওয়া যায়। তাছাড়া ‘ঘাটতি বাজেট’ শব্দদ্বয় শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই কারও কাছে বাজেট আতঙ্কের হলেও গনির কাছে নির্ভাবনার। আয়-ব্যয়ে অসামঞ্জস্য সর্বোচ্চ পর্যায়েই রয়েছে। ঋণখেলাপি, দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক বাড়ছে দেশে; একই দেশে অবস্থান করে গনিকে একা কেন প্যারা নিতে হবে! সুইস ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট নেই তাতে কী, আপাতত দেশীয় ব্যাংকেই হবে। ব্যাংকের টাকা মেরেও অনেকে ধনী হয়েছে, গনি করলে দোষ কী!
গনি মিয়ার বাজেট জ্ঞান
মলাট বৃত্তান্ত
শফিক হাসান
০৪ জুন ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জীবনাচারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে গনি মিয়ার। লোকজন এখনো অতীত আঁকড়ে থেকে উলটাপালটা বকতে ভোলে না। গনি মিয়া নাকি একজন গরিব কৃষক, তার নিজের জমি নেই, অন্যের জমি চাষ করে...। দেশে বাজেট এলে সঙ্গে আনে জুন মাসের গরম; তখনই লোকজন উলটাপালটা আচরণ শুরু করে।
গনি মিয়ারা আজীবন বোকা থাকে না, ঠোকর খেতে খেতে একসময় ঠিকই চালাক হয়ে যায়। সে দেখেছে, যে পরিমাণ টাকা দিয়ে চাষাবাদ করে অনেক সময় মূলধনই ওঠে না। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যদি এমন টানাহ্যাঁচড়ায় পড়তে হয়, কেন ঘানি টানতে হবে! গ্রামের মানুষ কত্ত বোকা! চিন্তায় চিন্তায় গনির মন অস্থির হয়ে উঠেছিল। অস্থিরতা বিরাজমান থাকতেই নিজের সব ‘জমিদার’কে গুডবাই জানিয়ে ঢাকায় এসে থিতু হয়েছে।
এ উলটাপালটা ঢাকায় অনেক মানুষ ফাঁকা আওয়াজ দেয়, এরা কেউই না খেয়ে থাকে না। বিভিন্ন পয়েন্টে মাজার থাকায় শিরনি-খিচুড়িও মিলে যায় সহজেই। রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলে পাওয়া যায় বিরিয়ানির প্যাকেট, সঙ্গে বোতলজাত পানিও। নগরজীবনের স্বাদ ক্রমান্বয়ে বুঝতে শিখল গনি মিয়া। সময়ে সময়ে পেশা পালটায় সে। ‘বদল’ই নগর জীবনের স্মার্টনেস। যে যত বেশি ‘পল্টি’ দিতে পারবে, সে তত অগ্রসর নাগরিক। ছেলেমেয়েরাও লায়েক হতে শুরু করেছে। আরেকটু বড় হলে এরাই সংসারের হাল ধরবে, পারিবারিক বাজেট প্রণয়ন করবে-গনি থাকবে চিন্তামুক্ত। ছেলেমেয়েরা কোটিপতি হতে শুরু করলে যারা তাকে ‘গরিব কৃষক’ বলে অঙ্ক মুখস্থ করে-সমুচিত জবাব দেওয়া যাবে!
রাজধানী চালাক-চতুর মানুষের জায়গা, এখানে সরল মানুষের ভাত-বার্গার কোনোটাই নেই। জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী একদিন বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দেয় গনিকে। ছেলেমেয়েরাও সাক্ষর, তার ‘অশিক্ষিত’ থাকাটা মানায় না। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষিত হয়েই মাথা ঘুরে যেতে লাগল। গনি মিয়া খেয়াল করল, নিয়ম করে জুনে বাজেট আসে, বাজেট এলে অনেক রকম জিনিসপাতির দাম বাড়ে। সরকার একবার বাড়ালে ব্যবসায়ীরা বাড়াবে তেইশবার। সরকার বিশ টাকা বাড়ালে ব্যবসায়ী বাড়াবে উনসত্তর টাকা। এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ওইসব বাজেট-ফাজেট না দিলে কী হয়! চিন্তার কথাটা একদিন শ্রেণিশিক্ষক মানসুরা রহমানকে জানাল। প্রথমে মানসুরা গম্ভীর হলেন, তারপর স্মিত হেসে বললেন, ‘আরে বোঝো না, বাজেট না দিলে এতকিছু হবে নাকি...?’
‘কতকিছু!’ হা হয়ে যায় গনি মিয়ার মুখ। বিস্ময়ে লকলক করে আলজিব।
মানসুরা স্মিত হেসে বলেন, ‘আরেকটু বড় হও, খুঁটিনাটি বুঝতে পারবে। জানবে, বাজেট কেন আসে। গান শোনোনি-অলি বারবার ফিরে আসে, অলি বারবার ফিরে যায়...?’
অনেক গানই শোনেনি সে, অলি মিয়ার কী সমস্যা তা-ও জানা নেই। নেই মাথাব্যথাও। চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজেট-নাট্য। এটি একইসঙ্গে গণমুখী-গণবিরোধী কীভাবে হয়! বানান করে পড়তে গিয়ে নিজের আরও মিতার সন্ধান পেল সে। গনি মিয়া বানান কী হবে- ন নাকি ণ? দুই রকমেরই দেখা মিলছে। এটা কি বাজেটের মতোই আরেক নৈরাজ্য! ভাবনার কথাটা জানালে মানসুরা ম্যাডাম বললেন, ‘তুমি দেখছি এখন চিন্তাশীল তাত্ত্বিক হয়ে উঠলে! তবু ভালো মিয়া বানানে য় নাকি ঞ শুদ্ধ এমন প্রশ্ন করোনি! আগে ঞ দিয়ে দিয়েই লেখার প্রচলন ছিল। এখনো কেউ কেউ লেখেন!’
‘কিন্তু আপা, আমরা তো শিখেছি ঞ-তে মিঞ! মানে বিলাই। বাজেটেও নাকি কালো বিড়াল আর কালো ব্রিফকেস থাকে?’
এবার বিরক্তই হলেন ম্যাডাম। ঝাড়ি মেরে বললেন, ‘বেশি বুঝতে চেয়ো না। পরে বিপদে পড়বে।’
কম বুঝে কি ঢাকায় চলা যায়! প্রতিবার বাজেটে দ্রব্যমূল্যের অগ্নি-হলকা বয়, আর গনি মিয়া সেসব শক্ত হাতে সামাল দেয়। তার বউ থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েরাও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি কমই! পাড়াপ্রতিবেশীরা প্রশ্ন করলে সহজেই জবাব দেয়, ‘শিক্ষিত মানুষ বেশি খাবে, পরবেও দামি পোশাক; এটাই স্বাভাবিক!’
ফি-দিন শিক্ষিত হয়ে ওঠা গনি মিয়া জানে ও মানে মনীষী-বচন-ঋণ করে হলেও ঘি খাও! ঘি শরীরকে দেয় বল, মাথাকে দেয় বুদ্ধি! ঋণের হাজারও উপকারিতা থাকতে পিছিয়ে থাকার মানে নেই। এখন কিস্তিতেও ঋণ নেওয়া যায়, সুদেও পাওয়া যায়। তাছাড়া ‘ঘাটতি বাজেট’ শব্দদ্বয় শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই কারও কাছে বাজেট আতঙ্কের হলেও গনির কাছে নির্ভাবনার। আয়-ব্যয়ে অসামঞ্জস্য সর্বোচ্চ পর্যায়েই রয়েছে। ঋণখেলাপি, দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক বাড়ছে দেশে; একই দেশে অবস্থান করে গনিকে একা কেন প্যারা নিতে হবে! সুইস ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট নেই তাতে কী, আপাতত দেশীয় ব্যাংকেই হবে। ব্যাংকের টাকা মেরেও অনেকে ধনী হয়েছে, গনি করলে দোষ কী!
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023