Logo
Logo
×

বিচ্ছু

রম্যগল্প

ঈদ শপিংয়ে হুজুগে বাঙালি

Icon

রোহিত হাসান কিছলু

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঈদ সামনে রেখে টিক্কু মিয়ার ফ্যাশন হাউস ‘কোদাল-জ’-এ মানুষের উপচে পড়া ভিড়। এত ভিড় যে, একজনের বগলের তলায় আরেকজনের মাথা দেখা যাচ্ছে! একটু আগে তো এক ভদ্রলোকের দু’পায়ের ফাঁকে একজনের মাথাও লক্ষ করা গেছে। দৃশ্যটা দেখে প্রথমে ভড়কেই গিয়েছিল টিক্কু মিয়া। তার ফ্যাশন হাউসে এলিয়েন চলে এলো নাকি? পরে ভালো করে তাকাতেই দেখেন, ওটা আরেক লোকের মাথা! এদিকে একটু আগে একটা জামা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে দু’জন অভদ্রমহিলা কিঞ্চিত আহত হয়েছেন। তাদের ঘিরে ছোট্ট একটা জটলার সৃষ্টি হয়েছে। এমন ভিড়ের মধ্যেই কাপড় চুরি হয়। টিক্কু মিয়া সেখানে কড়া নজর দিলেন।

দোকানে ভিড় বাড়ছে, আর ক্যাশ বাক্স ক্যাশে উপচে পড়ছে। টিক্কু মিয়া এবার আড় চোখে ক্যাশ বাক্সের দিকে তাকালেন। এদিকেও সমান নজর দিতে হবে। মানুষ আসলে পুরাই পাগল হয়ে গেছে। কোনো একটা পোশাক ধরে সেটি দেখার সময় নেই কারও। পোশাক হাতে কাউন্টারে এসে হাঁসের মতো প্যাক প্যাক করে বলছে, ‘প্যাক করে দেন, প্যাক করে দেন!’ অথচ তার ফ্যাশন হাউসে এখন কোনও অফার চলছে না! টিক্কু মিয়া বাঙালির এহেন আচরণে পুরাই হতবাক!

সুখের এ দিনে টিক্কু মিয়া মনে মনে তার বন্ধু সিস্টেম ছামচুকে ধন্যবাদ দিলেন। বন্ধুটা তার আসলেই কাবিল আছে। এ ফ্যাশন হাউসের নামটা ওই ছামচুরই দেয়া। সেদিন সে যখন বলল, তোর ফ্যাশন হাউসের নাম হবে কোদাল! তখন টিক্কু মিয়ার মেজাজ খুব খারাপ হয়েছিল। কোদাল আবার কেমন নাম! এটা কী কৃষি যন্ত্রপাতির কোনো দোকান নাকি! টিক্কু মিয়া কিছু বলার আগেই ছামচু বলল, ‘হতাশ হচ্ছিস কেন? নাম তো এখনও শেষ হয় নাই, কোদালের পরে একটা হাইফেন দিয়ে ‘জ’ লেখা থাকবে! পুরা ফ্যাশন হাউসের নাম হবে কোদাল-জ!’

টিক্কু মিয়া প্রশ্ন করলেন, ‘এটা কোনও জাতের নাম হল?’

বন্ধু সিস্টেম ছামচু হাসতে হাসতে জবাব দিল, ‘কোনো জাতের নাম হয় নাই। বাঙালি এখন জাত ছাড়া জিনিসই বেশি খায়! দেখবি তোর ফ্যাশন হাউসটাও খেয়ে দিবে!’

ছামচুর কথা সত্য। টিক্কু মিয়ার ফ্যাশন হাউস এখন কাস্টমাররা খেয়ে দিচ্ছে! ফ্যাশন হাউসের দারোয়ান কাদের গোডাউন থেকে মাল এনে কুলাতে পারছে না। এখন আবার সে গোডাউনে গেছে। মাল শেষ। গোডাউন অবশ্য বেশি দূরে না। ফ্যাশন হাউস থেকে দুই গলি পরেই টিক্কু মিয়ার বাসা। সেখানেই একটা রুমে ফ্যাশন হাউসের গোডাউন বানানো হয়েছে।

একটু আগে একটা সাদা ফতুয়ার মাঝে কটকটে লাল রঙের সুতার কাজ করে গোলাপ ফুল বানানো ফতুয়াটাও ছয় হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে গেল! টিক্কু মিয়া বসে বসে ভাবলেন, এ জিনিস কোনও দোকানদার তারে মাগনা দিলেও তিনি নেবেন না! আসলেই দেশে হচ্ছেটা কী? মানুষের বিবেক-বুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেল নাকি!

বন্ধু সিস্টেম ছামচু অবশ্য বলে, বাঙালির দুটি জিনিস খুব ভয়ঙ্কর! এক, বাঙালির আবেগ! দুই, বাঙালির হুজুগ! বাঙালি আবেগের বশে দিনকে রাত, রাতকে দিন করে দিতে পারে! আর হুজুগে বিবেক-বুদ্ধি সব লোপ পায়! এখন দোকানে যা ঘটছে, এটাকেই বলে বাঙালির হুজুগ। এ হুজুগ এখন টিক্কু মিয়াকে কোটিপতিও বানিয়ে দিতে পারে! সবই আসলে হুজুগের খেইল।

ফ্যাশন হাউসের মধ্যে একটা কোলাহল শোনা গেল। টিক্কু মিয়া সেদিকে নজর দিলেন। এক অভদ্রলোক পাঞ্জাবি না পেয়ে হাউকাউ করছেন। আবার মাল শেষ! টিক্কু মিয়া কাদেরকে আবার ইশারা করলেন। কাদের বেচারা মাত্রই মাল নিয়ে ফিরে এসেছে। টিক্কু মিয়ার নির্দেশ পেয়ে আবারও সে গোডাউনের উদ্দেশ্যে ছুটে গেল। টিক্কু মিয়া সেই হাউকাউ করা অভদ্রলোকের দিকে তাকলেন। অভদ্রলোক পাঞ্জাবির জন্য বেশ অস্থির হয়ে আছেন। মনে হচ্ছে এ পাঞ্জাবি না পেলে তিনি আর বাঁচবেন না! অদ্ভুত সব পাবলিক!

খানিকটা সময় নিয়ে টিক্কু মিয়া এবার ক্যাশের টাকা গোনায় মনোযোগ দিলেন। এমন সময় ধড়াম করে দোকানের দরজা খুলে গেল। টিক্কু মিয়া যখন ভাবলেন, দোকানে নির্ঘাত ডাকাত পড়েছে ঠিক তখনই দেখলেন, তার বউ দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে। মনে মনে টিক্কু মিয়া বললেন, ‘এর চেয়ে দোকানে ডাকাত পড়লে বেশি ভালো হইতো! ডাকাত পড়লে তাও পুলিশ ডাকা যাইতো। মামলা করা যাইতো। কিন্তু বউয়ের নামে কী এসব করা যাবে? এখন যে কী হবে কে জানে!’

টিক্কু মিয়া ভয়ে ভয়ে বউয়ের দিকে তাকালেন। বউ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আছে। দোকানে এখনও অনেক কাস্টমার। বউ এখন ঝগড়া বাঁধালেই ইজ্জত শেষ! টিক্কু মিয়া দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিলেন।

টিক্কু মিয়ার দিকে তাকিয়ে তার স্ত্রী রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘তোমরা শুরু করেছ কী?’

বউয়ের কথায় টিক্কু মিয়া আমতা আমতা করে বললেন, ‘কই, কী শুরু করলাম?’

বউ এবার কাদেরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই যে তোমার কাদের, বাসার সব কাপড় নিয়ে আসছে। একটু আগে জানালার পর্দাও খুলে এনেছে!’

টিক্কু মিয়া কাদেরের দিকে কড়া চোখে তাকাতেই কাদের মিনমিন করে বলল,‘কী করব স্যার, গোডাউনের মাল তো বহু আগেই শেষ!’

টিক্কু মিয়া কাদেরের দিকে তাকিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘তাই বলে জানালার পর্দা খুলে নিয়ে আসবি কাদের?’

কাদের মুচকি হাসতে হাসতে বলল, ‘স্যার, একটু আগে ওগুলোই তো ভোজবাজি শাড়ি নামে দশ হাজার টাকা পিস হিসেবে বেচে দিলাম!’

টিক্কু মিয়ার বউ এবার তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বলল,‘শুধু কী জানালার পর্দা? একটু আগে রহিমা বুয়ার ঘর মোছার ত্যানাও নিয়ে এসেছে!’

টিক্কু মিয়া বিষ্মিত হয়ে কাদেরের দিকে তাকালেন। কাদের এবার মাথা নিচু করে ফেলল। এমন সময় ক্যাশ কাউন্টারে এক ভদ্রলোক ছুটে এসে বলল, ‘ওফ! অনেক কষ্টে এবার ঈদে একটা জামা পছন্দ করতে পারলাম! এটা দ্রুত প্যাক করে দিন!’

টিক্কু মিয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখলেন, ভদ্রলোক যেটাকে জামা ভেবে নিয়ে এসেছেন সেটি আসলে জামা না! তার হাতে রহিমা বুয়ার সেই ঘর মোছার ত্যানা! তাতে ‘কোদাল-জ’ এর লোগোসহ পাঁচ হাজার টাকার প্রাইজ ট্যাগও ঝুলছে!

রোহিত হাসান কিছলু : রম্য লেখক।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম