বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চার আদ্যোপান্ত
মুহম্মদ জাকারিয়া শাহিন
বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চা শুরু
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা লক্ষণ সেনকে লখনৌ থেকে তাড়িয়ে বাংলা জয় করেন। বিজিত অঞ্চলে সংস্কৃতচর্চার মাধ্যম করে বাংলা ভাষাচর্চার পথ উন্মুক্ত করেন। এ বিজয়ের পর থেকেই মুসলমানদের সঙ্গে বাংলা ভাষার একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গ দেশে মসজিদ, খানকা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত করে তাদের ধর্ম-কর্ম সম্পাদন করতে থাকেন এবং বাংলা ভাষার মাধ্যমে দেশবাসীর প্রতি ইসলাম ধর্ম প্রচার ও ধর্মবিষয়ক গ্রন্থাবলী রচনা উৎসাহিত করেন। মধ্যযুগীয় কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর এদের অন্যতম। মাতৃভাষায় কোরআনি সাহিত্যচর্চার গুরুত্বটি ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগের কবি সৈয়দ সুলতানের (১৫৫০-১৬৪৮) ‘ওফাতে রসূল’ নামক কাব্য গ্রন্থেও প্রতিফলিত হয়েছে।
কোরআনের প্রত্যক্ষ বঙ্গানুবাদ ও তাফসির
১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির শাহ ওয়ালীউল্যাহ ফার্সি ভাষায় কোরআনের অনুবাদ করেন। এর ৬১ বছর পর ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ১৮০৮/১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে আমপারার একটি প্রত্যক্ষ বঙ্গানুবাদের সন্ধান মেলে। অনুবাদক ছিলেন রংপুরের মটুকপুরবাসী আমির উদ্দীন বসুনিয়া। এ খণ্ডিত অনুবাদটি ছিল বাংলা পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় আমপারার কাব্যানুবাদ। শাহ ওয়ালীউল্যাহর অনুবাদের ১৪৪ বছর পর ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) বঙ্গানুবাদ করে সম্পূর্ণ কোরআন ছাপেন ১৮৮১-১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। আমির উদ্দীন বসুনিয়ার পর কোরআনের বঙ্গানুবাদে এগিয়ে আসেন কলকাতার পাটওয়ার বাগানের আকবর আলী। ব্রিটিশ-ভারতের রাজেন্দ্রনাথ মিত্র, গিরিশ চন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০), খ্রিস্টান পাদ্রি তারাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, টাঙ্গাইলের মাওলানা নঈমুদ্দিন (১৮৩২-১৯০৮), দিনাজপুরের আকবর উদ্দিন, ব্রিটিশ-ভারতের একজন দেশীয় খ্রিস্টান শ্রী ফিলিপ বিশ্বাস প্রমুখ। এদের মধ্যে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বঙ্গানুবাদটি ছিল পূর্ণাঙ্গ আর অন্যদের অনুবাদ ছিল খণ্ডিত। গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদটি অনেকটা আক্ষরিক পর্যায়ের। এতে টীকা-টিপ্পনী সংযুক্তির ফলে এটিকে অর্থানুবাদও বলা যায়। এর ভাষা প্রাঞ্জল। তবে সংস্কৃত শব্দের প্রভাবও কম নয়। প্রাথমিক পর্যায়ের কোরআন হিসেবে বিভিন্ন মুসলিম পণ্ডিত ও সাহিত্যিকরা অনুবাদটির প্রশংসা করেছেন।
আকবর আলীর অনুবাদটি ‘তরজমা আমছেপারা’ নামে বাংলা পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় কাব্যানুবাদ। কলকাতা থেকে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মাওলানা নঈমুদ্দীন সর্বপ্রথম কোরআনের বঙ্গানুবাদসহ ভাষ্য রচনা করেন। তার অনূদিত কোরআন ১ম থেকে ৯ম পারা পর্যন্ত তার জীবদ্দশায় (১৮৮৭-১৯০৮) খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তার পুত্ররা ২৩ পারা পর্যন্ত কোরআনের বঙ্গানুবাদ ও ভাষ্য ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন। শ্রী ফিলিপ বিশ্বাসের অনুবাদটি ছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। অনুবাদটি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলে তৎকালীন জনতার প্রতিবাদের মুখে ব্রিটিশ সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে।
উনিশ শতকে বাঙালি মুসলিম পণ্ডিত ও সাহিত্যিকদের ধর্মপ্রচার ও কোরআনি সাহিত্যচর্চার ফলে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ তৈরি হয়। এ সময় খ্রিস্টান, আর্য, ব্রাহ্মধর্মের পণ্ডিতদের স্বধর্ম প্রচারে তৎপরতা লক্ষ করা যায়। তখন মুসলিমদের লেখনীও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও মুসলিম চেতনা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ অব্যাহত থাকে। বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনধারায় এর প্রভাব পড়ে। অখণ্ড ভারতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কোরআনের পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ ও ভাষ্যচর্চায় যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে মাওলানা মুহাম্মদ আব্বাস আলী (১৮৫৯-১৯২৩), মাওলানা তসলিমুদ্দীন আহমদ (১৮৫২-১৯২৭), আবুল ফজল আবদুল করিম (১৮৭৫-১৯৪৭), মুহাম্মদ আব্দুল হাকীম (১৮৮৭-১৯৫৭) ও মুহাম্মদ আলী হাসান, মাওলানা ওসমান গনি ও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অন্যতম (রহ.)। বিংশ শতাব্দীর সর্বশেষে কোরআনের পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ করেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (রহ.)। তার অনুবাদ আজও প্রকাশ হয়নি। ‘মহাবাণী’ নামে এর মাত্র ১০টি সূরার বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। হ [চলবে]
লেখক : প্রাবন্ধিক