কাবা চত্বরে প্রবেশকারী নিরাপদ
মঈন চিশতী
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
হজের বৈশ্বিক শিক্ষা : ‘লাক্বাদ সাদাকাল্লাহু রাসূলাহুর রুইয়া বিল হাক্ব। আল্লাহ আপনাকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছে। লাতাদখুলুন্নাল মাসজিদাল হারামা ইনশাআল্লাহু আমিনিনা মুহাল্লিক্বিনা রুউসাকুম ওয়া মুক্বাসসিরিনা লা তাখাফুন। ভয়ভীতিহীন হয়ে মাথা মুণ্ডিত এবং চুল কর্তিত অবস্থায় মসজিদে হেরেমে প্রবেশ করবেন। এ খাব দেখে নবী (সা.) সাহাবিদের নিয়ে বায়তুল্লাহ জিয়ারতে আসেন ষষ্ঠ হিজরিতে।
মক্কার মুশরিকরা খবর পেয়ে সুহাইল বিন আমের, ইকরামা বিন আবু জাহেলের নেতৃত্বে তাদের হুদাইবিইয়ায় আটকে দিয়ে এক সন্ধিচুক্তি করে। ফলে সে বছর উমরাহ না করেই তিনি মদিনা ফিরে যান। এ সন্ধিকে কালামে পাকে ‘ফত্হে মুবিন বা প্রকাশ্য বিজয়’ বলা হয়েছে।
কারণ এ সন্ধির ফলেই দাওয়াত ও তালিমের স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। স্থিতিশীলতা না পেলে কোনো কাজেই সুফল পাওয়া যায় না। এ স্থিতিশীলতার ফলে দীর্ঘদিন পর মদিনা প্রবাসী মুহাজিরদের সঙ্গে মক্কার সাধারণ নাগরিকরা ইসলামের প্রকৃত পরিচয় জেনে ইসলাম কবুল করতে থাকে। এবং সন্ধির আওতায় থেকেই মুসলিমরা বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে নানা ধরনের উন্নয়নমূলক চুক্তি করে ফেলে। সন্ধির কারণে মক্কার মুশরিক নেতারা প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকে।
একপর্যায়ে কোরাইশরা সন্ধির শর্ত ভেঙে ফেলে। নবী (সা.) এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ৮ম হিজরি ১০ রমজান দশ হাজার সাথী সৈন্য নিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করে ঘোষণা দেন, ‘লা তাসরিবা আলাইকুমুল ইয়াওমা আজ কোনো প্রতিশোধের দিন নয়, ইয়াগফিরুল্লাহু লাকুম, আজ ক্ষমার দিন। আল্লাহ তোমারদেরকে ক্ষমা করুন। আজ সাধারণ ক্ষমার দিন, যারা অস্ত্র ত্যাগ করবে তারা নিরাপদ। যারা ঘরে থাকবে তারা নিরাপদ। যারা কাবা চত্বরে প্রবেশ করবে তারা নিরাপদ। এমনকি যারা আবু সুফিয়ানের বাড়ির চত্বরে থাকবে তারাও নিরাপদ’। এরপর নবী খানায়ে কাবায় প্রবেশ করে কাবায় রক্ষিত মূর্তিগুলো ভেঙে কাবাচত্বরকে শিরকমুক্ত করেন। খানায়ে কাবার চাবি যারা বংশপরম্পরায় হেফাজত করছে তাদের কাছে রেখে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাদের হাতেই থাকবে এ অসিয়ত করে মদিনা চলে যান। সেই থেকে আজ অবধি তার বংশধরদের হাতেই আছে। যা বর্তমানে শাইবী বংশ বলে পরিচিত। আর তারা হলেন উসমান ইবনে তালহা (রা.)-এর বংশধর। সৌদি আরবের বাদশাহও যদি বাইতুল্লাহে প্রবেশ করতে চান তবে তাদের কাছে চাবি চাইতে হয়।
৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয় হলেও ওই বছরের হজ প্রাচীন রীতিতেই অনুষ্ঠিত হয়। ৯ম হিজরিতে মহানবী (সা.) সিদ্দিকে আকবর (রা.) কে আমিরুল হজ করে মুসলিম রীতিতে হজ করার জন্য পাঠান। মুশরিকরা তাদের প্রাচীন রীতিতে ওই বছর হজ করে। আবু বকর মক্কা রওনা হওয়ার পর সূরা তাওবার প্রথমাংশের আয়াতগুলো নাজিল হয়। যেখানে মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা আসে। যার অন্তর্নিহিত রহস্য হল খানায়ে কাবা থেকে শিরকের মূলোৎপাটন করতে হবে। কিন্তু মুশরিকদের রুসুম অনুযায়ী হজ প্রথা চালু থাকলে তা সম্ভব নয় তাই আলী (রা.) কে এ ঘোষণা দিয়ে আবু বকরের পেছনে পেছনে পাঠান। যেন আগামী বছর থেকে আর মুশরিকি প্রথায় হজ না হয় এ ঘোষণা দিতে। যারা ইসলাম কবুল করবে তারা হদ্দে হেরেমে বা হেরেমের সীমানায় থাকতে পারবে, আর ইসলাম কবুল না করলে সসম্মানে অন্যত্র আবাসন ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।
ইসলামে হজের রীতিনীতি বাস্তবে শিক্ষা দেয়ার জন্য ৩০০ মুসলিম সাথী নিয়ে নবীজি (সা.)-এর নির্দেশে সিদ্দিকে আকবর মক্কা আগমন করেন। এরপর অহি নাজিল হয় ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু হে ঈমানদারেরা, জেনে রাখ ইন্নামাল মুশরিকিনা নাজাসুন, মুশরিকরা আত্মিকভাবে নাপাক। ফালা তাক্বরাবুল মাসাজিদাল হারামা বা’দা আ’মিহিম হাজা, এ বছরের পর যেন তারা আর মসজিদে হেরেমের কাছে আসতে না পারে’।
এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর নবীজিকে সাহাবিরা পরামর্শ দেন এ ঘোষণাটি যেন আমিরুল হজ আবু বকরের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আরব রীতি অনুযায়ী কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ফরমান জারি করতে হলে নিকটাত্মীয় কর্তৃক ঘোষণা দেয়াতে হয়। তাই আলী (রা.) কে এ ঘোষণা দিয়ে পাঠান। আলী এখানে ঘোষণাকারী মাত্র, হজ কাফেলার আমির আবু বকরই ছিলেন। এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে ৪টি ফরমান সংক্রান্ত চিঠি লিখে আলীর হাতে দিয়ে বলেন, কোরআনের আয়াতের ঘোষণাটি শুনিয়ে এ চারটি ফরমানও মক্কার জনগণকে শুনিয়ে দেবে।
* যারা দ্বীন ইসলামকে অস্বীকার করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
* এবারের পর কোনো মুশরিক হজ করার জন্য আসতে পারবে না।
* এখন থেকে দিগম্বর তাওয়াফ নিষিদ্ধ করা হল।
* যাদের সঙ্গে রাসূল (সা.)-এর চুক্তি আছে এবং তারা তা ভঙ্গ করেনি তাদের মেয়াদ পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হবে।
চুক্তি বা সন্ধিবদ্ধ লোকদের ছাড় দেয়ার কারণ হল যাতে আমাদের হজের রীতিনীতি দেখে মক্কার মুশরিকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করে যথাযোগ্য মর্যাদায় এখানের নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারে। আর যারা ইসলাম কবুল করতে না চায় তাদের হুদুদে হেরেমের বাইরে চলে যেতে হবে। সেখানে তাদের যথাযথ নাগরিক সুবিধা দেয়া হবে।
এটাই হল হজের মানবতাবাদী বৈশ্বিক শিক্ষা। যা এখনও কা’বা চত্বরে বিরাজমান।
কাবার উসিলায় রঙিন হয় হৃদয় : পুরা সৌদি আরবে কোনো মহিলাকে বোরকা ছাড়া চলাফেরা করতে দেখবেন না কিন্তু কাবা চত্বরে এ নিয়মটি বেশ শিথিল। অনেকে দেখেছি স্বাভাবিক কাপড়েই তাওয়াফ করছেন (অবশ্য সতর ঢেকে)। এ ব্যাপারে কোনো সতর্ক করতে কাউকে দেখিনি। কিন্তু শিরকের আভাস পাওয়া যায় এমন কিছু করলে সতর্কতায় স্বেচ্ছাসেবকদের কোনো অবহেলা নেই। এর একটি কারণ খুঁজে পেয়েছি বর্তমানে অনেক তরুণ-তরুণী মুসলিম সন্তান হয়েও সঙ্গ দোষে নানা জটিলতায় ভোগে। তারা মানসিক প্রশান্তির জন্য কোনো মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে তিনি মুসলিম ভাবাপন্ন হলে মক্কা মদিনা জিয়ারতের কথা বলেন। আর সেক্যুলার হলে কোনো আনন্দভ্রমণে পাঠিয়ে দেন। আনন্দভ্রমণে গিয়ে ফতুর হওয়া ছাড়া কিছু থাকে না।
মুসলিম দেশের কর্পোরেট ব্যবসায়ীরাও তাদের পরিবেশকদের আনন্দভ্রমণের টিকিট এবং হোটেল খরচ দেন। আমার এক ছোট ভাই বছরে কয়েকবার এমন প্লেজার ট্রিপে যায়। আমি তাকে বললাম তোমাদের কোম্পানিকে পরামর্শ দেবে থাইল্যান্ড মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়ার ট্রিপ না দিয়ে আজমীর আগ্রা দিল্লি মক্কা-মদিনার ইত্যাদির ট্রিপ যেন দেয়। প্রস্তাবটি হাউসে উঠিয়ে দেখবে পাস হবে না। কারণ এসব ট্রিপের সঙ্গে তাদের ব্যবসা নেই। থাইল্যান্ড বালি ইত্যাদিতে ব্যবসা আছে। একদিক দিয়ে দেবে আরেকদিক দিয়ে তোমার পকেট ফতুর করবে।
মক্কায় হজ উমরাহকালীন দেখেছি অনেক ইন্দো-মালয় তরুণ-তরুণী বিয়ের পর পরই হজ বা উমরায় চলে আসেন যাতে আল্লাহর রহ্মতের করুণা ধারায় তাদের নব জীবন সুখে শান্তিতে ভরে ওঠে।
তো বলছিলাম খানায়ে কাবার এ বৈশ্বিক চেতনার কথা। মিসরের এক নারী ফিল্ম স্টার যিনি আরবি সিনেমার পরিচিত মুখ। হঠাৎ বাবাকে বলে আব্বু চল উমরাহ করতে যাব। বাবা আশ্চর্য হয়ে বলেন, সে কী? তুমি সিনেমার নায়িকা! উমরাহ কেন? মেয়ে বলে দুনিয়ার কত কিছুই তো দেখলাম মুসলিম সন্তান হিসেবে খানায়ে কাবা দেখার অধিকার আছে আমারও সেই সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হতে চাই না। তো বাপ-বেটি উমরাহর ভিসা নিয়ে কাবার ফাইভ স্টার হোটেলে লাগেজ রেখে রাত ১২টায় উমরাহ শুরু করেন।
উমরাহ সায়ি শেষ করতে করতে তিনটা বেজে যায়। মেয়ে বলে আব্বু তুমি বয়স্ক মানুষ, হোটেলে গিয়ে আরাম করে ফজরের জামাতে এসে শামিল হয়ো। আমি একটু মাতাফের খোলা চত্বরে বসে থাকি। একটু পর তাহাজ্জুদের আজান দেবে তাহাজ্জুদও এখানেই পড়ব। ফজর পড়ে তোমার সঙ্গে হোটেলে যাব ইনশাআল্লাহ’। তাওয়াফ সায়ি শেষে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ ক্লান্ত শ্রান্ত থাকে তার পরও মানুষ কাবা চত্বরেই বসে থাকে, কারণ কা’বায় প্রতি মুহূর্তে ১২০টি রহ্মত নাজিল হয় প্রতিটি তাওয়াফকারী সালাত-জিকিরকারী এবং কাবা দর্শনকারীর জন্য। এর মধ্যে ৬০টি তাওয়াফকারীর জন্য ৪০টি সালাত-জিকিরকারীর জন্য ২০টি দর্শনকারীর জন্য বরাদ্দ থাকে।
ওই মেয়ে সিরাতের কিতাবে পড়েছে রোকনে ইয়ামেনিতে নবীয়ে পাক (সা.) বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। তাই নবীর (সা.) বরকত ও ফায়েজ লাভের আশায় সেখানে বসে এক দৃষ্টে কাবা পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল খানায়ে কাবার প্রভাব তার হৃদয়ে ঢুকে গেছে। বাবা ফজর শেষে নিতে এলে মেয়ে বলে, তুমি হোটেলে চলে যাও। আমি এখানেই ইশরাক পড়ে যাব। ইশরাক শেষে বাবা এলে বলে মার্কেটে চলো আগে বোরকা কিনব তারপর হোটেলে যাব। কাবার উসিলায় আমার হৃদয় কাবার মালিকের রঙে রঙিন হয়েছে। একেই বলে ‘সিবগাতাল্লাহ’ আল্লাহর রঙে জীবন রাঙাও ‘ওয়ামান আহ্সানু মিনাল্লাহি সিবগাহ’ তার রঙের চেয়ে আর কার রং উত্তম?
লেখক : প্রাবন্ধিক
email:mueenchishty@gmail.com
