ভাষাশহীদদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা প্রত্যেক আলেমের ইমানি দায়িত্ব
তানজিল আমির
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মুফতি হুমায়ূন আইয়ুব, মাওলানা জহির উদ্দিন বাবর ও সুফিয়ার ফারাবী।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একটি মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের একজন ছাত্র কাগজের পতাকা সাজাচ্ছে। পতাকাগুলো জোড়া লাগিয়ে হিফজখানার দেয়ালে সাঁটাচ্ছিল ছোট্ট সেই কোরআনের পাখিটি। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, অন্য ছাত্ররাও পুরো মাদ্রাসাটি সাজাচ্ছে লাল-সবুজের রঙে।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদের দেখলাম। প্রতিটি কিশোরের চোখ-মুখ থেকেই দেশপ্রেমের ঝলক উদ্ভাসিত হচ্ছিল। খুদে হাফেজদের এ তৎপরতা আমাকে কিছুক্ষণের জন্য ফিরিয়ে নিয়েছিল পুরনো দিনগুলোয়।
আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, মক্তবে পড়ার সময় একদিন বিজয় দিবসে মাদ্রাসায় নিয়মিত ক্লাস চলছিল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, বাইরের রিকশা গ্যারেজে অনেক পতাকা উড়ছে। অথচ আমরা তখন জানিই না, আজকে বাংলাদেশে বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে।
এভাবে দীর্ঘ একটি সময় কেটেছে, সোজা কথায় বললে, কওমি মাদ্রাসাগুলোয় বিভিন্ন জাতীয় দিবসকে উপেক্ষা করা হতো। তবে কালের আবর্তনে পরিস্থিতি সন্তোষজনক না হলেও আজকাল পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে।
২০০৮ সালের পহেলা রমজান কওমি ছাত্রদের জন্য বাংলাসাহিত্য ও সাংবাদিকতার বুনিয়াদি একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিলেন হালের মেধাবী আলেম সাংবাদিক মুফতি হুমায়ূন আইয়ুব।
দেশের বরেণ্য আলেম ও সাহিত্যিকদের নিয়ে রাজধানীর চৌধুরীপাড়া মাদ্রাসায় মাসব্যাপী সে আয়োজনের সূচনাটা ছিল খানিকটা ব্যতিক্রম। আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়েছিল সেদিন। যেখানে বেফাকের মরহুম মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার, সংসদ সদস্য উবায়দুল মুকতাদির চৌধুরী, কবি আবু হাসান শাহরিয়ার, ড. মুশতাক ও হাফেজ আহমাদউল্লাহর মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
মাওলানা হুমায়ূন আইয়ুবের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, দীর্ঘ এ সময়ে কওমি মাদ্রাসায় ভাষাচর্চা কতটুকু এগিয়েছে? তার মতে, মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার দিনে দিনে বাড়ছে কওমি মাদ্রাসাগুলোয়। কয়েক বছর আগেও যেখানে বাংলাভাষার ইতিহাসের চর্চা সীমিত ছিল। দীর্ঘদিন ধরে কওমি মাদ্রাসাগুলোয় আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায় পাঠদান করা হতো। সেই ধারাকে ভেঙে বাংলাভাষার চর্চা বাড়ছে কওমি অঙ্গনে।
ঢাকার বেশকিছু মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করার পর আগ্রহী ছাত্রদের জন্য এক বছর বা দুই বছরব্যাপী বাংলাসাহিত্য, সাংবাদিকতা ও ইসলামী গবেষণা বিভাগ খোলা হয়েছে। এটি একটি পরিবর্তন।
বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরামের সভাপতি ও আলেম সাংবাদিক জহির উদ্দিন বাবর বলেন, কওমি মাদ্রাসাগুলোয় বাংলা চর্চা এক সময় নিষিদ্ধ ছিল। দেরিতে হলেও এ অঙ্গনের লোকদের বোধোদয় হয়েছে এবং গত ২০ বছরে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে তারা। এ সময়ে মাদ্রাসাপড়ুয়া একঝাঁক লেখক তৈরি হয়েছেন যারা এখন বিরামহীনভাবে লিখে যাচ্ছেন। তবে তাদের আরও অনেকদূর যেতে হবে।
তিনি বলেন, ইসলামী ধারার তরুণ লেখকদের প্লাটফর্ম হিসেবে আমরা বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছি। সারা দেশের তিন শতাধিক তরুণ লেখক এর সঙ্গে যুক্ত। আমরা চেষ্টা করছি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়ার। আমরা তরুণদের সংগঠিত করে বাংলাভাষা চর্চায় উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি।
সাভারের তরুণ আলেম সুফিয়ার ফারাবী। মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমেও কাজ করছেন।
তার মতে, ধর্মীয় ও জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত সবাইকে বাংলাভাষা নিয়ে কাজ করা উচিত। সাধারণ শিক্ষিতরা গদ্য ও পদ্য রচনায় এগিয়ে থাকলেও তুলনামূলক পিছিয়ে আছে কওমি মাদ্রাসার তরুণ লেখকরা।
ইসলামী ঘরানার অধিকাংশ লেখকের লেখা একঘেয়ে ধর্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। তাদের লেখা ধর্মীয় পাতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। মৌলিক সাহিত্যে তারা অনেকটা পিছিয়ে। আমি এ কথা বলব না যে, ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করা যাবে না। বরং ধর্মীয় লেখার পাশাপাশি মৌলিক সাহিত্যেও তাদের পদচারণা বাড়াতে হবে।
ফারাবী বলেন, ভাষাদিবস উপলক্ষে স্কুল, কলেজগুলোয় র্যালি, আলোচনা সভাসহ নানা আয়োজন থাকে। কিন্তু আমার জানামতে, কওমি মাদ্রাসাগুলোয় কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আয়োজন করে না, এটি খুবই দুঃখজনক।
এ ক্ষেত্রে কওমি মাদ্রাসাগুলো ইসলামের সীমারেখা ঠিক রেখে আলোচনা সভা, আনন্দ মিছিল র্যালি বা ভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাসাহিত্য চর্চার আয়োজন করতে পারে। তাতে বাংলাসাহিত্যে তাদের পদচারণা আরও মজবুত হবে।
এ ছাড়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ভাষাশহীদদের মাগফিরাত কামনায় আনুষ্ঠানিক দোয়ার মাহফিলের আয়োজন করলে ভাষাশহীদদের প্রতি কিছুটা হলেও ঋণ মুক্ত হওয়া যাবে। এটি আলেমদের ইমানি দায়িত্ব।
লেখক : আলেম ও গণমাধ্যমকর্মী
ই-মেইল : tanjilamir95@gmail.com
