মুক্তিযুদ্ধে অলি-আউলিয়া ও দরবার শরিফের ভূমিকা
সৈয়্যেদ নূরে আখতার হোসাইন
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর মাজার শরিফ জিয়ারত করছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছবি সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের আপামর জনসাধারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের হয়ে লড়াই করেছিল। শুধু চিহ্নিত একটি শ্রেণী-গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিল। মুক্তিকামী মানুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন এ দেশের মাটিতে শায়িত অলি-আউলিয়া, পীর-মাশায়েখ ও তাদের দরবার শরিফগুলো। সবার অলক্ষ্যে নীরবে-নিভৃতে থেকে অলি-আউলিয়ারা এ দেশের মুক্তিকামী মানুষকে বিজয়দানে আল্লাহ পাকের দরবারে কান্নাকাটি করেছেন। এ প্রসঙ্গে উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলিয়ে কামেল শামসুল উলামা আল্লামা হজরত শাহ সুফি সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হজরত জানশরিফ শাহ সুরেশ্বরী (রহ.) মাতলাউল উলুম গ্রন্থে লিখেছেন, অলি এবং আওলাদগণ হলেন প্রত্যেক শহর-বন্দরের ব্যবস্থাপক এবং রক্ষক। তাদের অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এবং তাদের সন্তুষ্টিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। তাদের অসন্তুষ্টির কারণে অবস্থা ও মর্যাদা পাল্টে যায়, মন্দ ও অনিষ্ট সংঘটিত হয়।
বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের মূল নায়ক ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হয়তো এটা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ইসলামপ্রিয়তা এবং ঈমান-আকিদার কারণে। তিনি রাজনীতি ও সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও কখনও ধর্ম থেকে দূরে থাকেননি। অলি-আউলিয়াগণের প্রতি ছিল তার অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস। যে কোনো শুভ কাজ শুরু করার আগে অলি-আউলিয়াগণের মাজার শরিফ জেয়ারতের মাধ্যমে তাদের দোয়া গ্রহণ করতেন। তিনি যে জেলায় সফরে যেতেন সেখানে শায়িত অলি-আউলিয়ার মাজার শরিফ জেয়ারত করতেন। আবার সফর শেষে অন্য কোনো অলির মাজার শরিফ জেয়ারতের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শেষ করতেন। অলি-আউলিয়াগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এ বিশ্বাস ও ভালোবাসা তাকে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছিল, যার চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটেছিল বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে।
অনেকে বলেন, এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়েছিল ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। আবার কারও মতে, ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলনে। তবে মুক্তিযুদ্ধের মূল পটভূমি ১৯৭০-এর নির্বাচন বাঙালি জাতিকে বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ দান করেছিল। নিজেদের দাবি ও অধিকার আদায়ের হাতিয়ার ছিল ভোটাধিকার প্রয়োগ। ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অর্জন করল নিরঙ্কুশ বিজয়। আমার বিশ্বাস, এ বিজয়ের পেছনে আল্লাহর অলিগণের আশীর্বাদ প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছিল।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭০-এর নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেছিলেন জুলাই মাসে। বাংলাদেশের সর্বত্র তখন ভরা বর্ষা। প্রচারাভিযানের সূচনায় বঙ্গবন্ধু ফরিদপুর জেলার বর্তমান শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার ঐতিহাসিক দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরিফের শাহ সুফি সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হজরত জানশরিফ শাহ সুরেশ্বরী (রহ.) ও তার পুত্র হজরত মাওলানা শাহ সুফি সৈয়্যেদ নূরশাহ (রহ.)-এর মাজার শরিফ জেয়ারত করে দক্ষিণ বঙ্গের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ভোরে ঢাকা থেকে হাইস্পিড কোম্পানির এমভি পাচগাঁও দোতলা লঞ্চে সুরেশ্বর দরবার শরিফের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রখ্যাত নেতা ও কর্মীরা। সেদিন সঙ্গে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক (সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী), তোফায়েল আহমেদ (বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী), এমএ রেজা, দেহরক্ষী মহিউদ্দীন আহমেদ ও অন্য নেতারা।
যাত্রাপথে তারা মুন্সীগঞ্জে কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি করেছিলেন। তারপর সরাসরি সুরেশ্বর দরবার শরিফে চলে আসেন। দরবার শরিফে অতিথিদের সাদর সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল। দরবার শরিফের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধেয় আওলাদরা অতিথিদের সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে আল্লাহর অলি রাসূলনোমা আল্লামা হজরত শাহ সুফি সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.), হজরত জানশরিফ শাহ সুরেশ্বরী (রহ.) ও হজরত নূরশাহ (রহ.)-এর পবিত্র মাজার শরিফ জেয়ারত করেন।
সেদিন বঙ্গবন্ধু দরবার শরিফ প্রাঙ্গণে এক জনসমাবেশে বক্তৃতা প্রদান করেন। বর্ষা বাদলের কারণে অতিথিদের বসার জন্য দ্বায়রা শরিফের সম্মুখ ভাগ বেছে নেয়া হয়েছিল। দরবার শরিফের পক্ষ থেকে হজরত শাহ নূরে আখতার হোসাইন প্রবন্ধ লেখক অতিথিদের শুভাগমন উপলক্ষে মানপত্র পাঠ করেছিলেন। মানপত্রের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জিন্দা অলি হজরত সুরেশ্বরী (রহ.) ও হজরত নূরশাহ (রহ.)-এর নেকনজর কামনা করে নির্বাচনী প্রচার শুরু করা এবং চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। যা এলাকাবাসীর মনে আজও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
অনুষ্ঠান শেষে সুরেশ্বর দরবার শরিফের শরীফীয়া নূরশাহ মঞ্জিলে হজরত শাহ নূরে বেলায়েত হোসাইন লালমিঞা শাহ ও হজরত শাহ নূরে আখতার হোসাইনের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু ও সহচররা মধ্যাহ্ন ভোজে আপ্যায়িত হয়েছিলেন। সময় স্বল্পতার কারণে অন্য সবার খাবার লঞ্চে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে সময় বঙ্গবন্ধু মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম শাফিয়া শরিফে যান এবং হজরত শাহ সুফি সৈয়্যেদ আমির আলী শাহের ও হজরত শাহ সুফি সৈয়্যেদ বুলবুল শাহ ওরফে বাদশা মিয়ার মাজার শরিফ জেয়ারত করেন। সে সময়ের গদিনশীন পীর সৈয়্যেদ মাহতাব উদ্দীন আহমদ তাকে বরণ করেছিলেন। এমনিভাবে তিনি সিলেটের হজরত শাহ জালাল (রহ.), হজরত শাহ পরান (রহ.), চট্টগ্রামের হজরত আমানত শাহ হুজুর ও ভাণ্ডার শরিফসহ বাংলাদেশের সব আধ্যাত্মিক দরবার শরিফে যোগাযোগ ও জেয়ারত করেন। সে সময়ের জাতীয় দৈনিকগুলোয় বঙ্গবন্ধুর এসব সফরের বর্ণনা ফলাও করে ছাপা হয়েছিল।
এভাবে বঙ্গবন্ধু এ দেশের প্রতিটি এলাকায় অলি-আউলিয়াদের দোয়া গ্রহণ করে এবং নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের ’৭০-এর নির্বাচনের সাফল্যকে অন্যভাবে মুক্তিযুদ্ধে জয়ের সাফল্যও বলা যায়। কেননা একটির ফলশ্রুতিতে অন্যটি অর্জিত হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন জেলায় সুরেশ্বর দরবার শরিফের লাখ লাখ ভক্ত-অনুসারীকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোটদানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। দেশের অন্যান্য দরবার শরিফ থেকেও একই রকম নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
ঐতিহাসিক দৃশ্যপটে যে সত্য তা হচ্ছে এ দেশের বেশিরভাগ অলি-আউলিয়ার দরবার শরিফগুলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছিল। আমি দেখেছি, মুক্তিসেনারা সুরেশ্বর দরবার শরিফে যাতায়াত করতেন এবং সেখানে অবস্থান করতেন। দরবার শরিফের আওলাদরা তাদের নিরাপদে আত্মগোপন করা, বিশ্রাম করা, খাওয়া ও অন্যান্য সহযোগিতা দিতেন। দরবার শরিফের অসংখ্য ভক্ত-অনুসারী প্রত্যক্ষ যুদ্ধের ময়দানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দরবার শরিফের পক্ষ থেকে সবাইকে দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের তাগিদ দেয়া হয়েছিল। শুধু সুরেশ্বর দরবার শরিফ নয়, দেশের সব আধ্যাত্মিক দরবার শরিফ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিল। আধ্যাত্মিক কামেল ব্যক্তি ও আল্লাহর অলিদের রুহানি যোগ-সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে থাকায় তারা ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ থাকেন। আর আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালা মতেই কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন।
এ প্রসঙ্গে হজরত বড়পীর মহিউদ্দীন আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) ফতহুল গায়ব গ্রন্থে অলি-আল্লাহগণকে শহর-নগরের নিয়ন্ত্রক উল্লেখ করে লিখেছেন, আউলিয়া কেরামের বরকতেই আকাশ ও জমিনের স্থায়িত্ব এবং জিন্দা ও মুর্দার স্থিতি বিরাজ করে। কেননা, তাদের পৃথিবীর খুঁটি ও পেরেক হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। যার কারণে প্রত্যেকেই একটি ভারী পাহাড় হয়ে নিজ নিজ স্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকেন। যতদিন আকাশ ও জমিন কায়েম থাকবে ততদিন আল্লাহর অলিদের ওপর আল্লাহর রহমত ও সালাম নাজিল হতে থাকবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও গদিনশীন পীর, দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরিফ
Email : ahmadinurisds@gmail.com
