Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

প্রেমের তাবলিগ প্রাণের কাকরাইল

Icon

তোফায়েল গাজালি

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রেমের তাবলিগ প্রাণের কাকরাইল

কাকরাইল মসজিদ।

মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ ‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও তোমরা তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও’।

আল্লাহর রাসূলের কালজয়ী এ বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুগে যুগে কত শুদ্ধ পুরুষ ধর্মের তাবলিগে পৃথিবীর পথে পথে ছুটে চলেছেন- তা আল্লাহই মালুম। তাবলিগ করতে গিয়ে নবীজি (সা.) কত নির্মম কষ্ট সহ্য করেছেন তা কারও অজানা নয়।

তায়েফের হৃদয়বিদারক ঘটনার পরও প্রিয় নবীজি (সা.) উম্মতের প্রতি যে প্রেম ও ভালোবাসা নিবেদন করেছেন তার নজির আরেকটি নেই।

তায়েফের অবিশ্বাসীদের রোমহর্ষক অত্যাচারে ক্লান্ত নবী (সা.)কে জিবরাইল (আ.) এসে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহপাক তায়েফবাসীদের ধৃষ্টতামূলক সব আচরণ ও দুর্ব্যবহার দেখেছেন এবং পাহাড়গুলোর দায়িত্বে নিয়োজিত এমন এক শক্তিশালী ফেরেশতা আপনার কাছে পাঠিয়েছেন- আপনি তাকে যা ইচ্ছা তাই আদেশ করতে পারবেন।

এরপর একজন ফেরেশতা হুজুরে পাক (সা.)কে সালাম করে বললেন- আমাকে যা ইচ্ছা আদেশ করতে পারেন। যদি আপনার নির্দেশ পাই তবে তায়েফের উভয় পাশের পাহাড়কে এমনভাবে মিলিয়ে দেব যেন সবাই এর মধ্যস্থলে নিষ্পেষিত হয়ে যায়। অথবা আপনার ইচ্ছানুসারে অন্য শাস্তির ব্যবস্থাও করতে পারেন।

কিন্তু দয়ার সাগর প্রিয় নবী (সা.) উত্তরে বললেন- আমি আল্লাহর দরবারে এই আশা পোষণ করি যে, যদি তায়েফবাসী পবিত্র ইসলাম গ্রহণ নাও করে তবুও তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন লোক পয়দা হবে যারা পবিত্র ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে একমাত্র আল্লাহ পাকের এবাদত বন্দেগি করবে।’

এটাই ছিল দয়ার নবীর প্রেমের তাবলিগ। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভীর (রহ.) প্রচেষ্টায় ভারতের দিল্লির মেওয়াত এলাকা থেকে শুরু হয় সেই প্রেমের তাবলিগের পুনর্যাত্রা।

নানা দুঃখ-কষ্ট ও শত বাধা বিপত্তির প্রাচীর ডিঙিয়ে ইলিয়াস (রহ.) মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে থাকেন বুকভরা দ্বীনের প্রেম ও নবীজির দরদ নিয়ে। জাহিলিয়াতের আরবরা নবীজির ডাকে সাড়া দিয়ে যে বিস্ময়কর আত্মিক ও বাহ্যিক উন্নতি সাধন করেছিল তার প্রতিচ্ছবি যেন আরেকবার ফুটে উঠল দিল্লির মেওয়াতে।

একজন দু’জন। এক ঘর থেকে আরেক ঘর। এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লা। দেশ থেকে দেশান্তরে। একদিন মেওয়াতের তাবলিগ ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বময়।

পঞ্চাশের দশকে দাওয়াতে তাবলিগের প্রাণপুরুষ মাওলানা আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর প্রচেষ্টায় ঢাকার আশপাশে তাবলিগের কার্যক্রম শুরু হয়।

তাবলিগ জামাতের প্রেমময় দাওয়াত অতি অল্প সময়েই বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তার, ধর্মের প্রচার ও সংরক্ষণের গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হয়।

ঢাকার রমনা পার্কে অবস্থিত কাকরাইল মসজিদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চলতে থাকে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম। এক সময় কাকরাইল মসজিদকে মালউয়ালি মসজিদ বলা হতো। ষাটের দশকে কাকরাইল মসজিদের মুরব্বিদের সমন্বয়ে ইঞ্জিনিয়ার হাজি আব্দুল মুকিত (রহ.) তত্ত্বাবধানে তিনতলা মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করেন।

কাকরাইলে প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনত চলে। এমনকি শেষ রাতে আল্লাহর দরবারে দোয়া-মোনাজাতের মাধ্যমে উম্মাহের কল্যাণ কামনা করার রেওয়াজ এ মসজিদের কম করে হলেও অর্ধশতাব্দীর।

আফসোসের কথা হলো- বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার তীর্থভূমি প্রাণের কাকরাইলেও আজ আর প্রেমের তাবলিগ নেই। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও নানা জটিলতায় শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত মসজিদটিও হারিয়েছে তার স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্যবোধ ও ঐতিহ্য।

সাদপন্থি ও যোবায়েরপন্থিদের দ্বন্দ্বে গেল বছর রক্তাক্ত হয়েছে শত পির আউলিয়া ও ধর্মপ্রচারকের সেজদার এ পাকজমি। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে চার সপ্তাহ আর দু-সপ্তাহ করে মসজিদ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে একেকটি পক্ষকে।

সংযতভাবে নিজ নিজ মতামত প্রকাশের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তাবলিগের এ বিভক্তিতে উম্মতের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা বোঝা যায় কাকরাইল মসজিদ ঘুরে এসে আগের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করলে।

গত সপ্তাহের ভর দুপুর বেলা। ঘুরে দেখলাম কাকরাইল মার্কাজের পুরো এলাকা। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে শূন্য মসজিদ ঘরের মেজেতে পুরোনো কতগুলো চট, থালা-বাসন, এলোমেলো সিট বেডিং-এর পাশে পাঁচ-সাতজন তাবলিগওয়ালার তালিমের হালকা ছাড়া তেমন কোনো লোক সমাগম চোখে পড়ল না।

একই চিত্র দেখা গেল ৩য় তলাতেও। অথচ এক সময় দিন-রাতের প্রতিটি মুহূর্ত ধর্মপ্রচারকদের পদচারণায় মুখরিত থাকত মসজিদের প্রতিটি তলা। বিদেশি মেহমানদের আসা-যাওয়া উদ্দীপ্ত করে তুলত দেশি চিল্লা ও সালের সাথিদের।

দাওয়াত ও তালিমে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত পুরো কাকরাইল এলাকা। হতাশার আড়মোড় ভেঙে সিঁড়ি দিয়ে নিচতলায় নামতেই দেখলাম বড় হরফে লেখা ইসতেকবালের জামাত (অভ্যর্থনার দল)। সালাম করে সেখানে বসলাম।

তেপায়ার ওপর ডাউস সাইজের রেজিস্ট্রি খাতা নিয়ে বসে আছেন আশরাফুল আলম নামক ষাটোর্ধ্ব এক মুরব্বি।

পরিচয় পর্ব শেষে তাবলিগের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে কথা বললে তিনি বলেন, এ বিভক্তিতে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হয়েছে তা হলো তাবলিগ জামাতের প্রতি মানুষের শত বছরের যে আস্থা ছিল সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। এক সময় মানুষ তাদের সন্তানকে নির্দ্বিধায় আমাদের হাতে তুলে দিত।

মানুষ বিশ্বাস করত যত বড় খারাপ লোকই হোক তাবলিগে গেলে ভালো হয়ে যাবে। এখন সাধারণ মানুষ ভয় পায় তাবলিগে গিয়ে কোথাও আবার আক্রমণের শিকার হতে হয় কি না। তবে আল্লাহর রহমতে মুরব্বিদের দোয়ায় আস্তে আস্তে এরকম শঙ্কাগুলোও কেটে যাচ্ছে।

নিয়মিত আল্লাহর রাস্তায় জামাত বের হচ্ছে। কথা হয় ময়মনসিংহ থেকে আসা চিল্লার সাথি ইলাস মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, সমস্যা তো ভাই ওপরে-নিচে নয়। আমরা সাধারণ মানুষ দ্বীনের মহব্বতে দাওয়াতের মেহনতে ঘর থেকে বের হয়ে আসছি। দু’পক্ষের মুরব্বিদের উচিত আমাদের এ ত্যাগের মূল্যায়ন করা। এভাবে চলতে থাকলে দ্বীনের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।

পিরোজপুরের মুহাম্মদ আলী। সত্তরোর্ধ্ব তাবলিগি মুরব্বি। আমাদের মজলিসে তিনিও এসে বসলেন। হৃদয় ভরা দরদ নিয়ে বললেন, মাওলানা সাদ সাহেবের অহংবোধই তাবলিগের এই ক্ষতির জন্য দায়ী। তাবলিগ চলবে পরামর্শের ভিত্তিতে- তিনি এটাতে বিলকুল নারাজ। পরামর্শ ছাড়া মীমাংসার কোনো পথ নেই।

ঢাকার রামপুরায় অবস্থিত জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম নতুনবাগ ও নান্নু মুন্সী জামিয়া ইসলামিয়া মুহাদ্দিস মুফতি রেজাউল করীমের সঙ্গে তাবলিগের চলমান সংকট উত্তরণের উপায় নিয়ে কথা বললে তিনি বলেন, তাবলিগ একটি খালেস দ্বীনি আন্দোলন। তাবলিগ জামাতের উদ্ভবের অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি ছিল আলেমদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, সেখানে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে তাবলিগকে কেন্দ্র করে আলেম ওলামা ও সাধারণ মানুষের মাঝে বিভক্তিই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

আসলে তাবলিগ জামাতের এই বিভেদ মূলত আদর্শিক একটি জায়গা থেকে দেখা দিয়েছে। মাওলানা সাদ কান্ধলভীর কিছু বক্তব্য ঘিরেই এর সূচনা হয়েছে। এসব বিষয় দারুল উলুম দেওবন্দ তাদের মতামত প্রকাশ করেছে এবং তাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে জাতির সামনে তুলে ধরেছে।

তবে এটি নিয়ে কখনো রাজপথে মোকাবিলা করার জন্য মিছিল সমাবেশ বা প্রতিরোধের ডাক দেননি তারা। এর বিপরীতে আমাদের দেশে আলেমরা এটা নিয়ে ময়দানে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।

কোথাও কোথাও প্রতিরোধ করেছেন। এতে করে সমস্যা আরও জটিল হয়ে পড়েছে। আমি মনে করি দু’পক্ষের সংলাপের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান এখনো সম্ভব।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বুলবুল সিদ্দিকী তার একটি লেখায় তাবলিগ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে জেগে ওঠা শঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন এভাবে “তাহলে কি তাবলিগ জামাত প্রায় শত বছর পরে একটি সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে তাবলিগ আবার তাদের ‘অহিংস ও অরাজনৈতিক’ আদর্শের দিকে ফিরে আসবে?

নাকি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এ নতুন বিশ্বে টিকে থাকার জন্য নিজেদের নতুনভাবে মানিয়ে নেবে? সমাজ পরিবর্তনের সামাজিক নিয়ম কিন্তু তাই বলে।

সময়ের প্রয়োজনেই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন মানিয়ে নেয়, তেমনি তাবলিগ জামাতও হয়তো ধর্মীয় পরিমণ্ডলে থেকে আবার নতুন করে বেড়ে উঠবে তাদের অহিংস নীতি নিয়ে।’ সব মতের সব পথের মানুষের পদভারে আবার মুখরিত হোক আমাদের কাকরাইল মসজিদ।

প্রেমের তাবলিগ প্রাণের কাকরাইল

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম