বিশ্বজয়ী হাফেজরা চান জাতীয় স্বীকৃতি
রাকিবুল হাসান
প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের হাফেজরা অংশ নিচ্ছেন আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায়। শতাধিক দেশকে পেছনে ফেলে হয়ে উঠছেন নাম্বার ওয়ান। পুরো বিশ্বের সামনে তখন ভেসে উঠছে লাল-সবুজের পতাকা। বাংলাদেশের কপালে এসব হাফেজরা একে একে যুক্ত করছেন গৌরব ও গর্বের রঙিন পালক।
কিন্তু বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে জয়ী করে তারা যখন দেশে ফেরেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কপালে জোটে না একটি সংবর্ধনাও। তারা যখন বিমানবন্দরে অবতরণ করেন, তাদের মনেই হয় না, বিদেশের মাটিতে দেশের নাম উজ্জ্বল করে তারা দেশে ফিরেছেন।
আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হাফেজদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে। এসব হাফেজদের জাতীয় স্বীকৃতি নেই বলে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে বিভিন্ন জটিলতার মুখে পড়তে হয় বলেও জানান তারা।
জটিলতা বলতে কী বুঝাচ্ছেন, জানতে চাইলাম। ২০১৭ সালে দুবাই হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় ১০৩ দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করেন হাফেজ তরিকুল ইসলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য দেশের হাফেজ যখন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হন, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের সঙ্গে দু’জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। একজন হাফেজদের কাগজপত্র রেডি করেন, আরেকজন বিদেশের মাটিতে তাদের সঙ্গে থাকেন। তাদের খাবার-দাবার, এমনকি প্রতিযোগিতার কোন দিন কোন পোশাক পরবে, তাও কর্মকর্তা নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু আমাদের এখানে উলটো। বিদেশে যাওয়ার জন্য যখন নির্বাচিত হই, ভিসার কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই পড়াশোনা লাটে ওঠে। আমরা যতজন বিদেশের মাটিতে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি, এই তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি সবাই হয়েছি। আমিই প্রস্তুতিই নিতে পারিনি দৌড়াদৌড়ির কারণে।’
হাফেজ সাইফুর রহমান তকি; ২০১৯ সালে জর্ডান হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। তার অনুভূতি হলো, জাতীয় স্বীকৃতি না থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পাই না। ফলে এ ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিদেশের ভাষা পারি না; তবুও একা একা যেতে হয়।
ভোগান্তি সয়েই তারা বিদেশের মাটিতে পা রাখেন। কুরআনের সুরে প্রস্ফূটিত করে তোলেন বাংলাদেশের গর্বিত মুখ। সাইফুর রহমান তকি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমরা যখন সব দেশের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে বিজয়ী হই, আমাদের নামের আগে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের নাম। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে লাল-সবুজের পতাকা। সবার চোখে থাকে জল। অদ্ভুত ঈর্ষা নিয়ে বিদেশিরা তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশি পতাকার দিকে।’
দেশকে যারা এমন ঈর্ষণীয় উচ্চতায় নিয়ে যান, তাদের জাতীয় স্বীকৃতি সময়ের দাবি। জাতীয় স্বীকৃতি ও সহযোগিতা পেলে আরও অনেকেই কুরআন প্রতিযোগিতায় উদ্বুদ্ধ হবে। সহযোগিতা না পেলে এ উৎসাহ একদিন হারিয়ে যাবে। হাফেজ তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই, আমাদের জাতীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক। জাতীয়ভাবে আমাদের যেখানে কাজে লাগানো যায়, কাজে লাগানো হোক। যেমন- সংসদে, রাষ্ট্রীয় সভায়, প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে এসব হাফেজদের দিয়ে তেলাওয়াত করানো হোক। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তাদের যত ধরনের সাহায্য করার, তা করা হোক। যেন হাফেজরা নির্বিঘ্নে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে। নয়তো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উৎসাহ হারাবে হাফেজরা।’
হাফেজদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হাফেজ নেসার আহমদ আন নাছিরী। হাফেজ তরিক এবং তকি তারই মাদ্রাসার ছাত্র।
হাফেজদের জাতীয় স্বীকৃতির যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সৌদির হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতা মসজিদুল হারাম এবং মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের হাফেজরা সেখানে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়ায়। আমাদের হাফেজদের যেহেতু আন্তর্জাতিক অঙ্গন স্বীকৃতি দিচ্ছে, তাদের এখন জাতীয় স্বীকৃতি প্রাপ্য।’
আক্ষেপ করে নেসার আহমদ আন নাছিরী বলেন, ‘কিন্তু হাফেজরা যখন বাইরের দেশে যেতে চায়, ভিসা-টিকিট নিয়ে তাদের দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। পড়াশোনায় তারা মন দিতে পারে না। পরে তারা যখন বিজয়ী হয়ে দেশে ফেরে, বিমানবন্দরে তাদের জন্য সামান্য সংবর্ধনাও দেওয়া হয় না। অথচ বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের একজন হাফেজ যখন বিজয়ী হয়, তার নাম কিংবা তার মাদ্রাসার নাম বলা হয় না। বলা হয় বাংলাদেশের কথা। তাই সরকারকে উদ্যোগী হয়ে দেশের নাম মহিমান্বিত করা হাফেজদের স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ছাত্র কেন দৌড়াদৌড়ি করবে। সরকার এর দায়িত্ব নেবে।’
তবে স্বীকৃতি মানেই টাকা নয়, বিষয়টি স্পষ্ট করে দিলেন নেসার আহমদ আন নাছিরী। তিনি জানালেন, ‘আমরা টাকা চাই না। চাই প্রতিভার মূল্যায়ন হোক। চাই, যে হাফেজরা দেশের নাম উজ্জ্বল করছে, প্রধানমন্ত্রী তাদের ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিন। এতে আরও অনেক প্রতিভাবান হাফেজ উৎসাহিত হবে। প্রতিভার মূল্যায়ন না হলে প্রতিভা জন্ম নেয় না কিংবা টিকে থাকে না।’
লেখক : প্রাবন্ধিক
