স্মৃতির আয়নায় ছেলেবেলার সিয়াম
আল ফাতাহ মামুন
প্রকাশ: ১৭ মে ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘তুই কয়টা রোজা রেখেছিস রে? আমি রেখেছি দুইটা। সাহরি খেয়ে দুপুর পর্যন্ত একটা। দুপুর থেকে ইফতার পর্যন্ত আরেকটা।’ ছোটবেলার আমরা এভাবেই রোজা রাখতাম। মাকে বলতাম, সাহরিতে উঠাবে কিন্তু। কোনোদিন যদি না উঠাতেন, তাহলে খুবই মন খারাপ নিয়ে দিন শুরু হতো আমাদের। মন খারাপ বেড়ে যেত যখন দেখতাম বন্ধুরা রোজা রেখেছে, কেবল আমিই রাখিনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আবার মন ভালো হয়ে যেত। ইফতার-তারাবির আনন্দ ভুলিয়ে দিত রোজা না রাখার কষ্টটুকু। আমাদের শৈশবের রমজান-স্মৃতি এ রকমই। আজকে যখন পরিণত বয়সে এসে রোজা রাখছি, তখন কি স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে ছেলেবেলার এসব রোজার কথা? আসুন! দেশসেরা তিন শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ এবং চিকিৎসকের মুখে শুনে নিই তাদের ছেলেবেলার সিয়ামের কথা।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান
ভাইস-চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঠিক কবে থেকে রোজা রাখা শুরু করি, দিনক্ষণ মনে নেই। খুব ছোট থেকেই আমাদের রোজা রাখার চর্চা শুরু হয়। তখন মা রোজা রাখতে দিতেন না। আমরা জোর করে থাকতে চাইতাম। আমার মনে পড়ে, ছোটবেলায় মা বলতেন, দরজার পেছনে লুকিয়ে কিছু খেয়ে নিলে রোজা ভাঙে না। (হা হা হা।) এভাবেই রোজার সঙ্গে প্রেম গড়ে ওঠে আমাদের। যখন ক্লাস টেনে উঠলাম, তখন পুরোপুরি রোজা রাখতে শুরু করেছিলাম। আমাদের স্কুলে মুসলিম হোস্টেল এবং হিন্দু হোস্টেল আলাদা ছিল। আমরা থাকতাম মুসলিম হোস্টেলে। সেখানে কে রোজা রাখল কে রাখল না, তারাবি পড়ল, পড়ল না- এসব খুব কড়াকড়ির সঙ্গে দেখা হতো। কেউ কেউ তারাবি না পড়ে চলে যেত যাত্রার আসরে। একদিন আমিও গেলাম। ফিরতে ফিরতে গভীর রাত হয়ে যায়। স্যার জিজ্ঞেস করলে বলি, আমি তারাবি পড়েছি। কিন্তু আমার চেহারায় রাত জাগার ছাপ ছিল। তখন স্যার কঠিন শাসন করলেন আমাকে। বললেন, নামাজ পড়নি সেজন্য শাসন করছি না। মিথ্যা বলেছ, তাই তোমাকে শাসন করছি। এখন রোজা রাখছি। যিনি গ্রহণ করার মালিক, তিনিই জানেন, আমার রোজা কতটুকু হচ্ছে। আমি চেষ্টা করছি, যতটুকু পারা যায়, সুন্দর-নিখুঁত রোজা রাখতে। বাকিটা আল্লাহপাকের ইচ্ছা।
এ, এম, আমিন উদ্দিন
সিনিয়র অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং সাবেক সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন
ছোটবেলায় আমি আজিমপুর কলোনিতে থাকতাম। বন্ধুরা রোজা রাখত। আমারও রাখতে ইচ্ছা হতো। মাকে বলতাম। কিন্তু মা রাখতে দিতেন না। একদিন সাহরির সময় উঠে সাহরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠেই মাঠে চলে যাই। সারা দিন খেলার পর বিকালে যখন বাসায় ফিরি তখন খুব ক্লান্তি ও পিপাসায় দুর্বল হয়ে পড়ি। আম্মুকে বলি, রোজাটা ভেঙে ফেলব। তখন আর আম্মু রোজা ভাঙতে দেন না। বললেন, ইফতারের আর অল্প সময় বাকি আছে। এখন ভাঙতে পারবে না। এরকম প্রায় দিনই হতো। সকালে আম্মু রাখতে দিতেন না। আর বিকালে ভাঙতে দিতেন না। ওইসময় ইফতার তৈরির দৃশ্যটা আমার খুব ভালো লাগত। এখনও যখন পরিবারের সঙ্গে ইফতার করি, তখন এ দৃশ্যটাই আমাকে গভীর আনন্দ বিলায়।
ডা. ফখরুল আমিন খান মৃদুল
সহযোগী অধ্যাপক, অর্থোপেডিক বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
তখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। হিমেল শীতের চাদর গায়ে রোজা আসত আমাদের পাড়ায়। কাসিদার মধুর সুরে ঘুম ভাঙত ভোররাতে। সবার চেহারায় এক অন্যরকম আবেগের ছাপ দেখতাম। একদিন আমিও সাহরি খেয়ে নিলাম। অন্য সবার মতো আমার মাও চাইতেন না, এত ছোট বয়সে আমি রোজা রাখি। যে দিন আমাকে সাহরিতে ডাকতেন না, রাগ করে ওই দিন সকালের খাবার খেতাম না। অবশ্য দুপুর গড়াতেই রাগ একদম পড়ে যেত। প্রথম রোজাটি যেদিন রেখে ফেললাম, সে কী আনন্দ। ভাষায় বোঝাতে পারব না- কতটা ভালো লেগেছিল সেদিন। বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রোজা রাখতাম। কে কার চেয়ে বেশি রোজা রাখতে পারে- এ প্রতিযোগিতা। এখনও যখন রোজার মাস আসে, স্মৃতির আয়নাটা প্রিয় ছবিগুলো মেলে ধরে হৃদয় পাতায়। কত মধুর-বর্ণিল ছিল ছেলেবেলার দিনগুলো মনে হয়। হায়! ছেলেবেলার রোজা-সাহরি-ইফতার সবকিছুই যদি আবার ফিরে পেতাম!
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
E-mail : alfatahmamun@gmail.com
