Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

বিদ্বেষ নয় শান্তি চাই

Icon

মাহমুদ আহমদ

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্বেষ নয় শান্তি চাই

সর্বত্রই যেন একটি জিনিসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একে অপরের প্রতি দয়ামায়া, ভালোবাসা যেন কমতে শুরু করেছে। সামান্য কারণে আমরা আজ উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছি।

ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ভুলে বসে আছি। সামান্য কারণে যারা সমাজে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, সবকিছুতে আমাদের আদর্শও হওয়া চাই শ্রেষ্ঠ। একে অপরের সঙ্গে বিভিন্ন কারণে মতবিরোধ থাকতে পারে, তাই বলে কারও ওপর আক্রমণ করে বসা মোটেও একজন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির কাজ হতে পারে না।

এ ছাড়া আমার প্রতিবেশী সে যে ধর্মের অনুসারীই হোন না কেন মানুষ হিসাবে তার একটি মর্যাদা রয়েছে। আমাদের সবার সৃষ্টি একই উৎস থেকে। যদি একই উৎস থেকে মানবজাতির সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে কেন নিজেদের মাঝে এত মারামারি আর বিভেদ। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে মারামারি এমনকি হত্যার ঘটনাও ঘটার সংবাদ পাওয়া যায়, যা ধর্মীয় শিক্ষাবিরোধী।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা একে অপরকে হিংসা করবে না, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ কর না, পরস্পরে বিদ্বেষ রেখ না, একে অপরের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ কর না, মূল্য নির্ধারণ হওয়ার পর চড়া দাম দিয়ে অন্যের সওদা ক্রয় কর না, হে আল্লাহর বান্দারা!

পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই, সে তার ভাই-এর ওপর জুলুম করে না, তাকে নিগৃহীত করে না এবং তাকে হীন জ্ঞান করে না। মহানবি (সা.) নিজ বক্ষপানে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিনবার বলেন, আততাকওয়া হা হুন্না অর্থাৎ তাকওয়া এখানে।

কোনো ব্যক্তি দূরভিসন্ধি আঁটবার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইদেরকে হীন জ্ঞান করে। প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত, ধনসম্পদ আর মানসম্মান অপর মুসলমানের জন্য হারাম।’ (সহি মুসলিম)।

এ হাদিসের ওপর যদি আমরা আমল করি তাহলে কি সমাজ বা দেশে কোনো ধরনের অন্যায় হওয়া সম্ভব? অবশ্যই না। শান্তির দূত বিশ্বনবি (সা.) তার সারা জীবন সমাজ ও দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।

মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রিজিকে প্রাচুর্য এবং জীবনের উন্নতি কামনা করে, তার জন্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিত’, (বোখারি)।

মহানবি (সা.)-এর মৃত্যুর অল্পদিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করল। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ’ (বায়হাকি)।

এ মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতিমালার একটি দিক উজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করেছে। শতধাবিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতাভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহ্বান।

আজ আমরা ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ভুলে গিয়ে আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে নির্মমভাবে হত্যা করতেও দ্বিধা করছি না। সামান্য বিষয় নিয়ে মারমুখী আচরণ করছি। যদিও সব ধর্মই চায় শান্তি, সব মানুষ চায় শান্তি অথচ আজ আমরা যেন অশান্তির মাঝে দিনাতিপাত করতেই বেশি পছন্দ করি।

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে কিংবা তাদের ওপর জুলুম করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি মুহাম্মদ ওই মুসলমানের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে লড়াই করব’, (সুনানে আবু দাউদ)। তিনি (সা.) আরও বলেছেন, ‘অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেই ওই ঘ্রাণ পাওয়া যাবে।’ (সহিহ বোখারি)।

আমরা যদি আল্লাহতায়ালার জান্নাতের প্রত্যাশা রাখি তাহলে আমাদের বিদ্বেষমূলক আচরণ পরিহার করতে হবে। আসলে যতদিন মানুষ মানুষকে না ভালোবাসবে ততদিন পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। পৃথিবী স্বর্গরাজ্যে পরিণত তখনই হতে পারে যখন মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে। মানুষের জন্য প্রেমপ্রীতি জন্ম না নিলে সে মানুষ হয় কীভাবে। সবার সঙ্গে, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন মানুষ হিসাবে তার প্রতি প্রীতিময় সম্পর্ক রাখার শিক্ষাই পবিত্র কুরআন আমাদের দিয়েছে।

শেষ করছি কবি নজরুলের মানুষ কবিতার দুটি লাইন দিয়ে, তিনি কত সুন্দরভাবেই না বলেছেন, গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে কিছু নাই/নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

তাই আসুন না, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে ভালোবাসি। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে বিশ্বনবি (সা.)-এর শিক্ষা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে মহানবি (সা.)-এর আদর্শ ও শিক্ষার ওপর আমল করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

বিদ্বেষ নয় শান্তি চাই

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম