কলম কুদরতের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি
মো. আবদুল গণী শিব্বীর
প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কলম আল্লাহর সেরা সৃষ্টি। তিনি মানবজাতিকে ‘জ্ঞান’ ও ‘হিকমাহ’ শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা উপকরণও সৃষ্টি করেছেন। কলম শিক্ষা উপকরণগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রথম।
জ্ঞান বিজ্ঞান, তথ্যাবলি ও উপাত্তগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজনে আল্লাহপাক কলম সৃষ্টি করেছেন। জগৎগুলোর স্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ‘আলিম’। আলামিন তথা জগৎগুলোর সব কিছুর জ্ঞান কেবল তিনিই রাখেন। তিনিই সব ধরনের জ্ঞানের ধারক ও সংরক্ষক। কেউই তাঁর সমকক্ষ নয়।
তাঁর এত প্রভাব প্রতিপত্তি এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর সৃষ্টি কৌশল হিসাবে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক মানবজাতির প্রয়োজন ও কল্যাণে তিনি কলম সৃষ্টি করেছেন। কলম মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যেমনটি জ্ঞান। জ্ঞানের প্রকাশ ও বিকাশ মূলত কলম ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সাধিত হয়। জ্ঞানের বাহন বইপুস্তক কলমের সাহায্যে লিখা হয়। যদিও বর্তমান জামানায় কম্পিউটার কিবোর্ড প্রয়োগে লিখা হয়। এক কথায় লেখনী কার্যক্রমের সূচনা হয়েছে কলম সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
পবিত্র কুরআন ও হাদিসে কলম শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। আল্লাহপাক কুরআন মাজিদে চার স্থানে কলম শব্দের উল্লেখ করে বলেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ থেকে। পড়, আর তোমার প্রভু অতিশয় মহিমান্বিত, যিনি তালিম (শিক্ষা) দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। তালিম দিয়েছেন ইনসানকে (মানুষকে) যা সে জানত না।’ (সূরা আলাক, আয়াত : ১-৫)।
তিনি আরও বলেন, ‘ইহা অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদ যাহা তোমাকে ওহি দ্বারা অবহিত করতেছি। মারইয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাহাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে ইহার জন্য যখন তাহারা তাহাদের কলম নিক্ষেপ করতেছিল তুমি তখন তাহাদের কাছে ছিলে না এবং তাহারা যখন বাদানুবাদ করতেছিল তখনো তুমি তাহাদের কাছে ছিলে না।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৪৪)। তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর সব বৃক্ষ যদি কলম হয় আর সমুদ্র হয় কালি এবং ইহার সঙ্গে আরও সাত সমুদ্র যুক্ত হয়, তবুও আল্লাহর বাণী নিঃশেষ হইবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা লোকমান, আয়াত : ২৭)। আল্লাহপাক স্বতন্ত্রভাবে সূরার নামকরণ করেছেন ‘কলম’ নামে। তিনি এ সূরার প্রথমার্ধে বলেন, নুন। শপথ কলমের এবং সেই বিষয়ের যা তারা লিপিবদ্ধ করে। (সূরা আল কলম, আয়াত : ০১)।
তাফসিরে বর্ণিত রয়েছে, ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন এবং তাকে লেখার নির্দেশ দেন। সে মতে কলম কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সব লিখে ফেলে। এ কিতাব আল্লাহর কাছে আরশে রক্ষিত আছে।’ (তাফসিরে কুরতুবি)। হজরত উবাদা ইবনে ছামিত (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম ‘কলম’ সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর কলমকে বললেন, লেখ। কলম বলল, হে প্রভু! কি লেখব? আল্লাহ বললেন, লেখ ইতঃপূর্বে যা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যা কিছু হবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৭০৭)। উল্লেখ্য, কলম তিন ধরনের। ১. আল্লাহর কুদরতি হাতে সৃষ্ট কলম, আল্লাহপাক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। (সূরা আলাক, আয়াত : ৪)। ২. ফেরেশতাদের কলম, যে কলম দিয়ে তারা মানুষের আমলনামা লিখেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তাকে একটি কর্মলিপি বের করে দেব এবং সে তা খোলা অবস্থায় পাবে এবং বলা হবে, তোমার আমলনামা পড়ে দেখ, আজ তুমিই তোমার নিজের হিসাবের জন্য যথেষ্ট’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ১৩-১৪)। ৩. সাধারণ কলম, মানুষ যে কলম দিয়ে জ্ঞানবিষয়ক কোনো কিছু লিখে।
এ প্রসঙ্গে তাফসিরে এসেছে, হজরত কাদাতাহ (রা.) বলেন, ‘কলম আল্লাহতায়ালার একটি বড় নিয়ামত। কলম না থাকলে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠিত থাকত না এবং দুনিয়ার কাজ-কারবারও সঠিকভাবে পরিচালিত হতো না।’
হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘এটা আল্লাহতায়ালার একটি বড় কৃপা, তিনি তাঁর বান্দাকে অজ্ঞাত বিষয়গুলোর জ্ঞানদান করেছেন এবং তাদের মূর্খতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে বের করে এনেছেন। তিনি মানুষকে লিখন বিদ্যায় উৎসাহিত করেছেন। কেননা এর উপকারিতা অপরিসীম। আল্লাহ ছাড়া কেউ তা গণনা করে শেষ করতে পারে না। যাবতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান, পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের ইতিহাস, জীবনালেখ্য ও উক্তি, আল্লাহতায়ালার অবতীর্ণ কিতাবগুলো সবই কলমের সাহায্যে লিখিত হয়েছে এবং পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অক্ষয় হয়ে থাকবে। কলম না থাকলে ইহকাল ও পরকালের সব কাজকর্মই বিঘ্নিত হবে’ (তাফসিরে মা’আরিফুল কুরআন, অষ্টম খণ্ড : পৃষ্ঠা : ২৪-২৫)।
কলম মানবজাতির প্রতি আল্লাহর দেওয়া আমানত। মানবজাতি এর সাহায্যে দুনিয়া ও আখেরাতের প্রভুত কল্যাণ লাভ করে থাকে। কলমের ব্যবহার স্বাভাবিক দুভাবে হয়ে থাকে। একটি হলো সদ্ব্যবহার আরেকটি হলো অসদ্ব্যবহার। ন্যায়নীতি ও কল্যাণের কাজে যার কলম ব্যবহৃত সে ব্যক্তি উত্তম। আর যার কলম অন্যায় দুর্নীতি ষড়যন্ত্র ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয় সে ব্যক্তি অসৎ ও অধম। কেরামান কাতেবিনের কলমে মানুষের ভালোমন্দ সবকিছুই ‘আমলনামা’ নামীয় বিশেষ সংরক্ষিত কিতাবে লেখা হয়। মানবসৃষ্ট সাধারণ কলম অন্যায়ভাবে ব্যবহৃত হলেও আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাদের কলম সর্বদা সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত কাজে ব্যবহৃত হয়। মানুষের তৈরি কলম নষ্ট হতে পারে, হারাতে পারে, সংস্করণ বা ডিজাইনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর কুদরতি কলম সর্বদা অপরিবর্তনীয়। আল্লাহর কলমের প্রকৃতরূপ কেমন তা জগতের মানুষ কোনো কালেই অনুমান করতে অপারগ।
লেখক : মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদ্রাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী।
