বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আরবি ভাষায়
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে মানুষটির নাম সবার আগে উঠে আসে, তিনি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের মানুষকে জুলুম-নির্যাতনের শেকল ভেঙে স্বাধীনতার মুক্ত আকাশে ওড়ার সবক দেয়া এ মানুষটি সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন সম্ভবত হাফেজ আহমাদ উল্লাহই করেছেন।
সত্তরের দশকের ছড়াসাধক হাফেজ আহমাদ উল্লাহ তার সাড়া জাগানো গ্রন্থ আলোকিত মানুষের খোঁজে লিখেছেন, ‘দীর্ঘ সাধনা করে সাধারণ মানুষ যেমন সাধক হয়ে ওঠে, তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানও মানব সাধক বনে গেলেন। মুজিব যখন সাধক হন রহমান তখন কবুল করে নেন তার সব আরজি। কেননা মুজিবুর মানে কবুলকৃত। রহমান মানে আল্লাহ। সফেদ পুরুষটির নামের অর্থ দাঁড়াচ্ছে- মুজিবুর রহমান মানে আল্লাহর কবুলকৃত বান্দা। শেখ হচ্ছে তার বংশধারা।’
অসম্ভবও সম্ভব হয়, যদি তার কবুলকৃত বান্দার ছোঁয়া পায়। তাই তো একদল প্রশিক্ষিত সশস্ত্র হানাদার বাহিনীর মোকাবেলায় নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালি বিজয় ছিনিয়ে আনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আঙুলের ইশারায়। যে আঙুল লাখো জনতার সামনে উঁচু হয়ে নির্দেশ করেছিল, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম; সে আঙুলই জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে আলোর মশাল কলম হাতে লিখেছে অমর গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এটি শুধু আত্মজীবনীই নয়, বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের ইতিহাস ফুটে উঠেছে এ গ্রন্থে।
ইংরেজি, জাপানি, চীনা, ফারসি ও তুর্কি ভাষার পর এবার আরবি ভাষায়ও তরজমা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২০১৬ সালে গ্রন্থটির আরবি অনুবাদ করেন ফিলিস্তিনের অনুবাদক মো. দিবাজাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইয়েদ আবদুল্লাহ আল মারুফের দক্ষ সম্পাদনায় অনুবাদটি হয়ে ওঠে ঝরঝরে। গ্রন্থটির আরবি অনুবাদ ও সম্পাদনার নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- আল ফাতাহ মামুন
যুগান্তর : একজন অ্যারাবিয়ানের অনুবাদের পর আপনি সম্পাদনা করেন। অনুবাদ ও সম্পাদনা দুটো সম্পর্কেই আপনার মূল্যায়ন কী?
আবদুল্লাহ আল মারুফ : সন্দেহ নেই মো. দিবাজাহ একজন দক্ষ অনুবাদক। কিন্তু যে গ্যাপ ছিল তাহল, তিনি ইংরেজি থেকে আরবি অনুবাদ করেছেন। ফলে অনেক জায়গায় লেখকের মূল বক্তব্য ফুটে ওঠেনি। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার পরিচয় না থাকায় আরবি অনুবাদ অনেকটা নিরস হয়ে পড়ে।
প্রাণহীন এ অনুবাদকে প্রাণময় ও প্রেমময় করে মূল লেখকের আবেগ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। সে ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পুরো বইটিই আবার নতুন ছাঁচে ঢেলে সাজাতে হয়েছে। এখন অসমাপ্ত আত্মজীবনীর আরবি অনুবাদ যার নাম ‘সিরাতে জাতিয়াতে লাম তাকতামিল’ যথার্থ অনুবাদ বলে দাবি করা যায়।
যুগান্তর : গ্রন্থটি সম্পাদনার অভিজ্ঞতা বলুন।
আবদুল্লাহ আল মারুফ : ফিলিস্তিনি অনুবাদক দিবাজাহর কাছে ইংরেজি অনুবাদে ভুল আছে মনে হল। তখন তিনি বাংলাদেশে এসে তিন মাসে এটির অনুবাদ শেষ করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, এ অনুবাদটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মারুফকে দেখানো হোক। দেখার পর মনে হল, অনুবাদের অনুবাদ হওয়ায় অনেক জায়গায় অনিচ্ছাকৃত বড় বড় ভুল থেকে গেছে। যেমন এক জায়গায় বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু বৃদ্ধার বাড়ি গিয়ে সুপারিগাছের পাতা খেয়েছেন। আসলে কথাটি হবে, বঙ্গবন্ধু বৃদ্ধার বাড়ি গিয়ে পান খেয়েছন। জহুরুল হককে লেখা হয়েছে জহিরুল হক। অথচ দু’জন দুই ব্যক্তি। আমি বললাম, এ অনুবাদ যথার্থ নয়। অনুবাদের দায়িত্বে ছিল সেনাবাহিনী। তারা আমাকে বললেন, একজন দক্ষ অনুবাদককে দিয়ে অনুবাদ করানো হয়েছে। তারপরও যথার্থ নয়? আমি তাদের বুঝিয়ে বলি, ইংরেজি থেকে আরবি অনুবাদের ফলে বঙ্গবন্ধুর আবেগ ও অনুভূতি যথাযথভাবে ফুটে ওঠেনি গ্রন্থে। তখন তারা আমাকে সম্পাদনার দায়িত্ব দিলেন।
তারপর আমার সম্পাদনা শেষে সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসার প্রুফ দেখেন। আমিও দেখেছি। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০১৬ সালে কুয়েত থেকে মনরম প্রচ্ছদ ও ঝকঝকে ছাপায় বইটি প্রকাশ পায়।
যুগান্তর : বইটির প্রকাশনা উৎসব কবে হল।
আবদুল্লাহ আল মারুফ : বড় দুঃখের কথা হল, বঙ্গবন্ধুর ওপর আরবি ভাষায় এত বড় কাজ হয়েছে, কিন্তু দেশে এখনও কোনো প্রকাশনা উৎসব হয়নি। আরব বিশ্বে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরার এত বড় সুযোগ আমরা হাতছাড়া করছি। আমাকে এক অ্যারাবিয়ান রাজনীতিবিদ বলেছেন, ‘পাকিস্তান যেভাবে তাদের নেতাকে উপস্থাপন করতে পেরেছে, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সেভাবে নিজেদের ইতিহাস মেলে ধরতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আরব বিশ্বে যে ভুল ধারণা সৃষ্টি করেছে, এ গ্রন্থটি পড়ে তা ভেঙে যাবে।
যুগান্তর : তার মানে প্রচার-প্রসারে ভূমিকা নেয়া হয়নি!
আবদুল্লাহ আল মারুফ : সীমিত সংখ্যক বই ছেপে বিলি করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে তো একশ বা হাজার কপি বই ছাপানো যথেষ্ট নয়। লাখ লাখ কপি ছেপে অল্প দামে আরবী ভাষাভাষী মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে দিতে হবে। গ্রন্থটি এখনও বাংলাদেশে বাজারজাত হয়নি। এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী আছে। অথচ মাদ্রাসা পড়ুয়া এবং অনুবাদের ছাত্রদের জন্য এটি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। আমি আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।
যুগান্তর : এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট বড় ভূমিকা রাখতে পারে?
আবদুল্লাহ আল মারুফ : রাখা তো দরকার। কিন্তু কেন যেন সেরকম হচ্ছে না। তবে আমি আশা করি, মাননীয় প্রধানন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা একটি জমকালো প্রকাশনা উৎসব করবেন। সেখানে আমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যাবাদ জানাব- বঙ্গবন্ধুর ওপর এত বড় কাজের সুযোগ আমাকে দেয়ার জন্য।
যুগান্তর : জানতে পেরেছি, এ কাজের জন্য আপনাকে কোনো সম্মানী দেয়া হয়নি।
আবদুল্লাহ আল মারুফ : বঙ্গবন্ধুর জন্য কোনো কাজ করতে পারাটাই গৌরবের। সম্মানীর আশা করিনি। কিন্তু কাজের মূল্যায়ন হোক, প্রচার-প্রসার হোক- একজন বঙ্গবন্ধু প্রেমিক হিসেবে এটা আমি চাই। কিন্তু আজো বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।
লেখক : শিক্ষার্থী, অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাস্টার্স, ডিপার্টমেন্ট অব তাফসির, মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা
E-mail: alfatahmamun@gmail.com
