পাঠক রস
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়
সাঈদুর রহমান লিটন
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মিজান সাহেব একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। দেখতে বেশ স্মার্ট, স্বভাবেও ভালো। সহকর্মীরা বলেন, ‘মিজান ভাই খুব ভালো মানুষ। অফিসে এমন কোনো কাজ নেই, যা তিনি সামলাতে পারেন না। সৎ, দায়িত্বশীল-সব গুণে পরিপূর্ণ মানুষটি।’
কিন্তু একটা ছোট, বড়ও বলা যায়, সমস্যা আছে তার। সেটা বসভীতি। অফিসের বস জনাব আব্দুল ওহাব মোল্যা। স্যুট-টাই পরা, কড়া মেজাজের লোক। তাঁর সামনে দাঁড়ালে সাহসী বাঘও বিড়াল হয়ে যায়। আর মিজান সাহেব? বসকে দেখলেই হাত-পা কাঁপে, জিভ জড়িয়ে যায়, চোখে ঝাপসা দেখেন।
একদিনের ঘটনা। অফিসে বস হঠাৎ ঢুকছেন। মিজান সাহেব বসের ছায়া দেখেই তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াতে গেলেন। কিন্তু ভাগ্য বেচারার সাথে ছিল না। টেবিলের ওপরের ফাইল উলটে মেঝেতে পড়ল, কাগজপত্র উড়তে লাগল। যেন হেমন্তের শুকনো পাতা। তাতে যোগ হলো কলমদানি। সেটা গড়িয়ে গিয়ে সোজা বসের পায়ে গিয়ে ঠুকল।
বস তাকালেন কপাল কুঁচকে।
মিজান তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘স-স-সরি স্যার!’
অফিস সহকারী রফিক মিয়া দৌড়ে এসে বলল, ‘থাক স্যার, আমি উঠায়ে দিচ্ছি।’
বস মুখে কিছু না বলে গম্ভীরভাবে নিজের রুমে ঢুকে গেলেন। আর মিজান সাহেব ভাবলেন, হায় রে, আমি কেন এমন করি? বস দেখলেই হাত-পা কাঁপে কেন? এই জন্যই প্রমোশনটা আটকে আছে।
তবে বস কিন্তু তাকে অপছন্দ করতেন না। বরং ভালোই বাসতেন। কারণ কাজের মানুষ তিনি। অন্য অফিসাররা যেখানে ফাইল একপাশে রেখে গল্পে মশগুল, মিজান সাহেব সেখানে বসে হিসাব মেলাচ্ছেন, রিপোর্ট লিখছেন, পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন।
অফিসের গাম্ভীর্যের বাইরে মিজান সাহেবের আরেক রূপ আছে। রোমান্টিক মিজান। তার প্রেমিকা মিরা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, আধুনিক, সুন্দরী, হাসিখুশি এক তরুণী। দুজনের দেখা হয় নিয়মিত। অফিস শেষে ক্যাফেতে, কখনো পার্কে, কখনো বা ছোটখাটো ভ্রমণে।
মিরার বাবার কথা উঠলে অবশ্য মিজান একটু ঘাবড়ে যান। মেয়েটি একদিন বলল, ‘শোনো মিজান, আমি কিন্তু বাবাকে তোমার কথা বলে ফেলেছি। উনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান।’
মিজান হকচকিয়ে বললেন, ‘সে কী! তোমার বাবা কি রাগী মানুষ?’
মিরা হেসে বলল, ‘না, উনি খুবই সিরিয়াস টাইপের মানুষ। তবে তুমি যদি একবার কথা বলো, উনি তোমাকে পছন্দ না করে পারবেন না।’
মিজান একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আচ্ছা, দেখি আমার বসকে বলে ছুটি পাই কিনা। উনাকে দেখলেই তো বুক কাঁপে!’
মিরা হেসে বলল, ‘আহা! ভয় পেলে চলবে না। তুমি একবার ড্যাডকে জয় করো, তারপর দেখো, অফিসের ওই ভয়ংকর বসকে আর সহ্য করতে হবে না। আমার বাবার অফিসেই তুমি জেনারেল ম্যানেজার হবে।’
একদিন সকালে অফিসে ঢুকেই মিজান সাহেব শুনলেন, বস তাকে খুঁজছেন। দেখা করতেই গম্ভীর গলায় বস বললেন, ‘মিজান সাহেব, কাল দুপুরে কিন্তু আমার বাসায় লাঞ্চে আসবেন। আমার বাসায় এক বিশেষ অতিথি আসবে, আপনাকে তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আপনার বুদ্ধি-বিবেচনা পরীক্ষা করারও সুযোগ হবে।’
বুদ্ধি-বিবেচনা শুনেই মিজান সাহেবের গলা শুকিয়ে গেল। বললেন, ‘জি স্যার, ঠিক আছে।’
বস হাসলেন, ‘চিন্তা করবেন না, খুব সাধারণ একটা লাঞ্চ।’
এরপরই মিরা ফোনে বলল, ‘মিজান, কাল আমাদের বাসায় লাঞ্চে আসবে। বাবা তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
মিজানের মুখ হাঁ হয়ে গেল। একদিকে ভয়ংকর বসের দাওয়াত, অন্যদিকে হবু শ্বশুরের মিটিং উইথ লাঞ্চ। দুই জায়গায় একসাথে যাওয়া সম্ভব নয়। মরিয়া হয়ে মিরাকে ফোন করলেন মিজান, ‘মিরা, একটু শোনো তো, কাল আমি হয়তো আসতে পারব না।’
কিন্তু ফোনের ওপাশে কোনো সাড়া নেই। রিং বাজে, কেউ ধরে না। আবার চেষ্টা, তাও ব্যর্থ। মিজান হতাশ মুখে বললেন, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়! বসের বাসায় না গেলে চাকরিটাই যাবে।’
পরদিন মিজান ঝকঝকে শার্ট পরে, আতর মেখে, বসের বাসার পথে রওনা দিলেন। বসের দারোয়ান তাঁকে গেস্টরুমে বসাল। কিছুক্ষণ পর বস এলেন হাসিমুখে, ‘চলুন মিজান সাহেব, ডাইনিংয়ে চলুন। আজ একসাথে লাঞ্চ করি।’
বস টেবিলে বসেই ডাকলেন, ‘এই মিরা মা, তোর মেহমান এলো না নাকি? আয়, আমার মেহমান এসেছে, একসাথে খেয়ে নে।’
মিজান এক ঝটকায় চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। মি... মি... মিরা? অমনি পরের মুহূর্তেই ডাইনিং রুমে প্রবেশ করল মিরা, তার হাতে এক বাটি সালাদ, মুখে হাসি।
মিরা চমকে উঠে বলল, ‘আরে! তুমি কখন এলে?’
‘আমি তো কেবলি এলাম। তুমি এখানে?’
‘আমার বাসায় এসে আমাকেই জিজ্ঞেস করছো আমি এখানে কেন?’
মিজান বাকরুদ্ধ। বসের বাসা মানে মিরাদের বাসা! এ কী কপাল!
মিরা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ড্যাড, উনিই তো মিজান! যার কথা আমি তোমাকে বলেছি।’
বস বললেন, ‘এই যে মিজান সাহেব, যাঁকে আমি প্রতিদিন অফিসে দেখি! তো এই হলো তোমার প্রেমিক?’
মিজান কাঁপতে কাঁপতে গ্লাস হাতে নিতে গেলেন। আর তখনই ছপাৎ করে পানি গিয়ে পড়ল বসের গায়ে। মিরা মুখ চেপে হাসছে, বস বললেন, ‘গর্দভ!’
ঘরজুড়ে নিরবতা। তারপর হালকা হাসি। বস বললেন, ‘তোমার মতো ভীতু ছেলেকে প্রেম করতে দেখেও আমি অবাক হই! অফিসে তুমি ভয় পাও, এখন আমার মেয়েকেও ভয় পাবে নাকি?’
মিরা তাড়াতাড়ি বলল, ‘ওকে ভয় দেখিও না! ও খুব ভালো মানুষ।’
বস একটু মুচকি হাসলেন, ‘তা জানি। ওর কাজ আমি নিজে দেখি। তবে প্রেম করতে গিয়ে যদি ফাইল ফেলে দাও, তখন কিন্তু বেতন কেটে নেবো।’
মিজান সাহেব বলল, ‘জ্বি স্যার।’
বস এবার বিড়বিড় করে বললেন, ‘গর্দভ!’
মিজান বসের কথা ভালো করে না শুনেই বললেন, ‘জি স্যার!’
মধুখালী, ফরিদপুর
