Logo
Logo
×

বিচ্ছু

বই মেলা কই মেলা

Icon

অয়েজুল হক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নীলা চলে গেল ফুল দিয়ে। ভালোবাসার ফুল হাতে ধরিয়ে এক মাস পরই অন্য একজনের হাত ধরে চলে গেল। মারুফের কান্না, অশ্রু দেখে ওর বন্ধু কবির পরামর্শ দিয়েছিল, এই বিরহ ব্যথা কাজে লাগা। কবি হয়ে যা।

‘কবি হতে পারবো!’

‘হ্যাঁ, পারবি। প্রেমিকা হারানো ব্যথার যে আগুন তোর বুকের ভেতর জ্বলছে তাতে মনে হয় তুই বিরাট কবি হয়ে যাবি।’ সেই থেকে শুরু। বহুদিন ধরে লেখালেখি করলেও সাফল্য আসছে না। এই যে কত পত্রিকায় লেখা পাঠায়। আসে না, ছাপে না। সাফল্যের ভেতর একবার এক পত্রিকা অফিস থেকে ফোন করেছিল। ফোন রিসিভ করতেই ওপ্রান্তে বেশ সুন্দর গলায় একজন বলে ওঠে, ‘মারুফ সাহেব...।’

‘জি, বলুন।’

‘আমি সম্পাদক বলছিলাম।’

‘ও আচ্ছা, আমিই কবি মারুফ।’

‘আপনি আর লেখা দেবেন না।’

‘লেখা চান বলেই তো দেই।’

‘কোথায় লেখা চাই?’

‘কেন, পত্রিকায়। লেখা পাঠান এই মেইলে...!’

‘ও, আচ্ছা। ভাই, আপনার লেখা পড়তে পড়তে আমার ক্লান্তি এসে গেছে। প্লিজ। এ লাইনে আপনার যোগ্যতা শূন্য। অহেতুক সময় নষ্ট করছেন।’

‘সময় কী আপনার না আমার?’ ওপাশ থেকে কিছু না বলেই লাইন কেটে দেয়। তারপর থেকে পত্রিকায় লেখা বন্ধ। তাই বলে থেমে যাবার পাত্র সে নয়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নেয়- বই বের করার। প্রকাশক ধরে বইয়ের কাজ চূড়ান্ত করে ফেলে। এবার দেখবে তার সাফল্য কে আটকে রাখে! মেলা কাছে আসতেই প্রচারণা শুরু করে মারুফ। ফেসবুক, বন্ধু মহল, ছোট ভাই গ্রুপ, আত্মীয়স্বজন। কথা একটাই, বই আসছে। কেউ প্রশ্ন করতেই মারুফ উজ্জ্বল চেহারায় জবাব দেয়, ‘মুড়ি ভাজি খাই খৈ, এটা হল কবিতার বই।’ মারুফের ফুফাতো ভাই হিমেল বলে, ‘কেমন খাই খাই ধরনের বই হয়ে গেল না?’

‘সেটাই তো চাই। পাবলিক খেলেই হয়। মেলায় ঝাঁক ঝাঁক পাবলিক বইটা গোগ্রাসে গিললে হয়।’

হাফিজুর বিয়ের জন্য উতলা হয়ে পড়েছে। সারা দিন যদি একশত কথা বলে তার আশিটা হয় বিয়ে আর বউ নিয়ে। তার কাছে বই আর বইমেলার কথা বলতেই বিমর্ষচিত্তে বলে, ‘সব তো আছে- বস্ত্র মেলা, পাট মেলা, তাঁত মেলা, শিল্প মেলা, আয়কর মেলা, বাণিজ্য মেলা, কম্পিউটার মেলা, আইটি মেলা, পিঠা মেলা, গাড়ি মেলা, বাইক মেলা, সিনেমা মেলা, বইমেলা। ভাইজান, বউ মেলা কি হবে!’

মারুফ দাঁড়ায় না। চলে যায়। মেলা জমতেই কবি ঢাকা গিয়ে হাজির। একটা আবাসিক হোটেল ঠিক করে উঠে পড়ে। প্রথম রাতে শুয়ে শুয়ে ফিরোজকে ফোন করে। ফিরোজ বন্ধু মানুষ। ঢাকায় থাকে বহুদিন।

‘এবার মেলায় কদিন তোদের বাড়িতে থাকব।’

‘বাড়ি তো বাড়িওয়ালার। আমরা ভাড়া থাকি।’

মারুফের রাগ হয়। বললেই তো হয় থাকা যাবে না। শত হলেও সে কবি। এখানে কাউকে তেলাতে আসেনি। মেলাতে এসেছে। যে কদিন থাকে হোটেলেই থাকবে। খট করে কলটা কেটে দেয়। একটু পরই দরজায় খুটখুট শব্দ হয়। মারুফ দরজা খুলতেই দেখে এক যুবক দাঁড়িয়ে।

‘কী চাই?’

‘কিছু চাই না স্যার, আপনার কোনো কিছু লাগবে স্যার?’

‘না, আমি এখন ঘুমাবো। ঘুম লাগবে।’

‘ধন্যবাদ স্যার।’

‘ওকে, গুড নাইট।’

‘জি স্যার। কী নাইট?’

‘গুড নাইট।’

‘এনে দিচ্ছি স্যার।’

‘কী এনে দিচ্ছেন?’

‘স্যার কয়েল।’

‘আমি কয়েল!’

‘আপনি কয়েল হতে যাবেন কেন। আপনি তো কবি।’

‘তো!’

‘ওই যে বললেন গুড নাইট। ফুয়েল, কয়েল।’

মারুফ ফিক করে হেসে দেয়। এই শহরটাই পাগল টাইপের! পরদিন ঘুম থেকে জেগে দেখে সকাল, দুপুর গড়িয়ে, খুঁড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি উঠে মেলার দিকে চলল। বইমেলায় কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করতেই কয়কজন পথ আটকাল। লিডার ধরনের এক ব্যক্তি সামনে এসে বলল,‘কার কার কী কী বই কিনবেন?’

‘মানে!’

‘মানে পাঠক হিসেবে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?’ মারুফ একগাল হাসে, ‘ভাই, আমি তো কবি। কবি মারুফ।’

কবি শুনেই ওনারা ক্যামেরা নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেন, ‘আচ্ছা কবি হিসেবে আপনার বইয়ের কথা বলুন।’

নতুন মানুষ। তারপর এই শহরে এসে যে ধকল যাচ্ছে! ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সব ভুলে যায়। আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘এই তো কবিতার বই।’

‘আপনার বই কেমন চলছে?’

‘এক্স ক্রুজ মিসাইল। জি, চলছে।’

‘বুঝলাম না ঠিক, মানে বইটা ক্রুজ মিসাইলের গতিতে চলছে?’

‘আমি কী বলি আর আপনি কী বলেন! বইয়ের সঙ্গে মিসাইল টেনে আনার মানে কী!’

‘সেটা তো আপনি বললেন। যাক, বাংলাসাহিত্যের এই যে উৎসব এ সম্পর্কে কিছু বলুন।’

‘বইমেলা আসলে খুব সুন্দর। এখানে যারা আসেন, দেখছি তারাও বেশ সুন্দর-সুন্দরী। তো...!’ মারুফের গলা শুকিয়ে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

‘জি, তারপর?’

‘তার আর পর নেই!’

‘শুধু আপন আছে?’

‘সেটাও বলতে পারছি না। আপনি আমারে মাফ করেন ভাই। এবারের মতো মাফ করেন।’

তারপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। হঠাৎ মারুফ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে একটা বেডে শোয়া সে। পাশে আরও অনেক মানুষ। তারাও শোয়া। সারি সারি। মারুফ বিড়বিড় করে বলল, ‘বইমেলা! কই মেলা?’

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম