|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমি খুব গম্ভীর চেহারা নিয়ে বাবার সামনের চেয়ারে বসে তার চেহারা পড়ার চেষ্টা করছি। খুব স্পষ্ট কিছু বুঝতে না পারলেও সে যে কনফিউজড এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাবার সামনে আমার গত দুই বছরের রিপোর্ট কার্ড খোলা। তিনি আমাকে কিছু না বলে আমার মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা আসিফের মা, এ মেয়ে গত বছরও ৮৫ পেয়ে পাস করেছে! এই বছরও অঙ্কে ৩৩ পায় কীভাবে!’
আমার মা এর মধ্যে পদ্মার ২% পানি আমাদের বসার ঘরে এনে ফেলেছেন! আরও ০.৫% পানি তার চোখ দিয়ে বের করতে করতে বললেন, ‘আমি কী জানি! আরও মাথায় উঠাও মেয়েকে! ওই বাড়ির তাশফিয়া ৯০ পেয়েছে। গত বছর ৮০ পেয়েছিল বলে কত কথাই না শুনালাম- আর এবার কিনা আমার ৮৫ পাওয়া মেয়ে ৩৩ পেয়ে ঘরে আসল! হায় আল্লাহ, এ মুখ আমি এলাকায় দেখাই কী করে!’
বাবা তার গম্ভীর কণ্ঠে মাকে থামতে বললেন। আসলে আমি যে ৩৩ পেয়েছি এ নিয়ে মায়ের কোনো চিন্তা নেই সেটা আমি জানি। চিন্তা হল এলাকায় ভালো ছাত্রদের মায়েদের একটা স্ট্যাটাস থাকে সেই স্ট্যাটাস মায়ের আর মেইনটেইন করা সম্ভব হল না! আমি আর আমার বড় ভাই আসিফ দু’জনই খুব ভালো ছাত্র। আমাদের এক বেলা ভাত না খেলেও চলবে কিন্তু পড়া ছাড়া আমাদের চলে না।
ভাইয়া এসে একবার আবহাওয়ার অবস্থা দেখে আবার পড়তে বসেছে। বাবার মুখের সামনে দুই জোড়া রিপোর্ট কার্ড এখনও খোলা। তিনি যে আমাকে কিছুই বলবেন না সেটা আমি খুব ভালই জানি। পত্রিকায় কিশোরীর পড়ার চাপ এ ঘর ত্যাগের খবরটা আমি গত সপ্তাহে বাবাকে পড়তে দেখেছি।
বাবা-মা যা-ই বলুক, আমার এ মার্কস অর্জনের পেছনে যে আমাকে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে এটা একমাত্র আমি জানি! ভেবে দেখুন তো, চোখ বুজে লিখেও যে আমি মিনিমাম ৭৫ পাই সেই আমির ৩৩ পেতে কি খাটনি করতে হয়েছে! পড়ার সময় হলে নিজেকে পড়া থেকে দূরে রাখা এক ধরনের যুদ্ধ। ক্লাসে জানালার বাইরে তাকিয়ে জীবনের কতগুলা দিন গেল, আর কত দিন বাকি আছে এ ধরনের গভীর বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়েছে। স্যারের জিজ্ঞেস করা অঙ্কের উত্তর জেনেও বাংলা সিনেমার স্মৃতিশক্তি হারানো নায়িকার এক্সপ্রেশন দেয়াও একটা আর্ট!
আমার মধ্যে যে এত প্রতিভা কিলবিল করছে তা কোনো দিন জানাই হতো না! যদি না আজ থেকে পাঁচ মাস আগে আমাদের ক্লাসে সেই নতুন ছেলেটা আসত! যেহেতু সে ক্লাসে নতুন তাই প্রথম কয়েকদিন হেড স্যারের কথায় তাকে আমার পাশে ফার্স্ট বেঞ্চে বসানো হয়েছিল। আমার তো তখন থেকেই মনের এলোমেলো অবস্থা শুরু। ওই এক মাসে নিজেদের বাচ্চার নামও ঠিক হয়ে গিয়েছিল আমাদের। সব ঠিকই চলছিল, ভেজালটা হল এক মাস পর যখন আমি বুঝতে পারলাম এ ছেলে আসলে ফার্স্ট বেঞ্চার না!
ক্লাসে পড়ার মাঝে ঘুমান, রুটিন দেখে বই-খাতা না আনা, স্যারদের অকারণে রাগ দেখে খি খি করে হাসা- এসব তার কাছে মামুলি ব্যাপার। একবার বিজ্ঞানে আমি ৬৫ পেয়ে প্রায় কেঁদেই দিয়েছিলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি সে ৪০ পেয়ে বিস্মিত চোখে খাতার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছিল হাতে সোনার ডিম পাড়া মুরগি পেয়েছে। ওইটা অবশ্য পরে আমি টিচার্স রুমে খাতা রাখতে গিয়ে শুনেছি, নতুন ছাত্রকে অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য বিজ্ঞান স্যারই কিছু নাম্বার বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
যাই হোক, এভাবে কিছু দিন যাওয়ার পর দেখলাম আমার ক্র্যাশ এক বেঞ্চ করে পিছে যেতে শুরু করেছে। এভাবে ২-৩ মাস পর সে পারমানেন্টভাবে ব্যাক বেঞ্চে চলে গেল। এদিকে আমি পড়ে রইলাম ফার্স্ট বেঞ্চে! অনেক চিন্তা-ভাবনা করেও বুঝে পেলাম না তাকে কাছে থেকে কিভাবে একটু দেখা যায়। টিফিন টাইমে সে ঘুমায়। আমি কখনও তার সঙ্গে কথা বলার সাহস পাইনি। ব্যাক বেঞ্চারদের এক ধরনের ভাব থাকে, ফার্স্ট বেঞ্চারদের সঙ্গে কথা বললে তাদের এ ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। সে ব্যাক বেঞ্চে অনেক বন্ধু এর মধ্যে জোগাড় করে ফেলেছে। আমি তার বন্ধু তো দূরের কথা বন্ধুর বন্ধুও হয়ে উঠতে পারিনি এখনও।
তাই একদিন বেশ খানিক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে এ সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমার ক্র্যাশ যেহেতু ব্যাক বেঞ্চার তার আশপাশে থাকতে হলে আমাকেও ব্যাক বেঞ্চার হতে হবে। ইশ, এতদিনে ক্র্যাশ-এর কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছি। কাজের টাইমে কাজ না করে ঘুরে বেড়ানো একটা বিরাট বড় কাজই বটে! যাই হোক, সব খারাপ যার শেষ ভালো তার। মানে হল সব সাবজেক্টে খারাপ করে এখন আমিও পরের টার্ম থেকে একজন ব্যাক বেঞ্চার হয়ে উঠলাম!
