Logo
Logo
×

বিচ্ছু

বউ কাঁদছে

Icon

খায়রুল বাবুই

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইংরেজি বই এবং বাঙালি বউ- দুটোই যিনি বুঝতে পারেন, তিনিই সত্যিকারের সফল পুরুষ! আফসোস, এই দুটোই আমার কাছে সবসময়ই দুর্বোধ্য!

বউয়ের চোখে জল মানেই স্বামীর সুখ-শান্তিতে ভাটার টান। সে যার বউ-ই হোক-না কেন, ওই সময়টায়, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে বউয়ের কান্না থামানোর চেয়ে পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই থাকে না। বিখ্যাতদের বউয়ের কথা বাদ, আমার মতো সাধারণের বউ যখন কাঁদে, নিজের তো বটেই, অনেকেরই খবর হয়ে যায়! বউয়ের কান্নার খবর পাড়া এবং প্রতিবেশী জানা মানে- মান নিয়ে টানাটানি। বউয়ের একদিনের কান্না- প্রতিবেশীদের কমপক্ষে এক মাসের গসিপের খোরাক!

প্রশ্ন হল, বউ কেন কাঁদে? নিশ্চয়ই শাশুড়ির সঙ্গে বিবাদ! অথবা স্বামীর কেয়ারলেস মনোভাব! কিংবা গায়ের রং, কথার ঢং, কাজের সং-ইত্যাদি নিয়ে পরস্পরবিরোধী খোঁচা!

প্রতিবেশীরা অবশ্য এরও বেশি কারণ খুঁজে বা বুঝে নেয়। বানিয়ে নেয় নিজেদের মতো রসগল্প।

বউ কাঁদছে মানে-সংশ্লিষ্ট স্বামী বিনা বিচারে দোষী।

বউ কাঁদছে মানে-সংসারে অনটন। অশান্তি। ঘর এই ভাঙল বলে...!

বউ কাঁদছে মানে-আহারে, বউটা কী দুঃখী! স্বামীটা কী পাজি!

তখন স্বামী-নামক মানুষটির সব যুক্তি-চেষ্টা-আকুতি ভেসে যায় বউয়ের চোখের জলে।

এক চমৎকার ছুটির দিনের সকাল।

আমার ঘুম ভাঙল কান্নার শব্দে। কে? পাশ ফিরে দেখি-না, বউ নেই। তার মানে কি বউ নয়? কান্নার সুরটা প্রিয় ‘ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস’ গানের মতোই বহুল পরিচিত। তবে গানের সুর ভীষণ প্রিয় হলেও কান্নার সুর যেন ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ!’

এই কান্না অতীতে আমাকে ভুগিয়েছে বেশ ক’বার। ভবিষ্যতেও যে ভোগাবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তবে বর্তমান নিয়ে শঙ্কিত।

বেডরুম থেকে বেরোতই কান্নার শব্দ বাড়ল। হুঁ, বউ কাঁদছে; আমারই বউ।

মনে মনে ১০০, ৯৯, ৯৮...থেকে ১ পর্যন্ত উল্টো গুনে ধৈর্য সঞ্চয় করলাম। আসন্ন কথোপকথন-পর্বের জন্য তৈরি করলাম সম্ভাব্য কয়েকটি প্রশ্ন।

টেবিল থেকে এক গ্লাস জল গলায় ঢেলে উঁকি দিলাম রান্না ঘরে। বউ পেঁয়াজ কাটছে। এই একটি মাত্র দৃশ্য আমাকে ব্যাপক স্বস্তি এনে দিল। অজান্তেই গুনগুন করে উঠলাম-তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হতো না...।

ড্রইংরুমে এসে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। টিভির রিমোট নিয়ে ‘অন’ বাটনে চাপ দেব, তখনই বিষয়টা ধরতে পেরে লাফিয়ে উঠলাম। পেঁয়াজ কাটার সময় বউয়ের চোখে জল আসতেই পারে কিন্তু ফুঁপিয়ে কাঁদবে কেন?

গলা শুকিয়ে এলো। জগ থেকে আরেক গ্লাস জল কমল। একটু আগের স্বস্তি এখন সস্তা আবেগ। রান্না ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। পেঁয়াজের ঝাঁজ এসে লাগল আমার চোখে। বউ চোখ তুলে তাকাল। দুই জোড়া ভেজা চোখ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বউ চোখ নামিয়ে নিল। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শাড়ির আঁচলে নাকের পানি চোখের পানি মুছল একবার। আঁচলটা টেনে নিয়ে নিজের চোখ জোড়া মুছে নিতে ইচ্ছা হল আমার; সাহস হল না।

উত্তর পাব না-ধরে নিয়েই বেশ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললাম,‘কী হয়েছে?’

আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে বউ বলল,‘কিছু না।’

জবাব পেলাম, উত্তর পেলাম না। এবার প্রশ্নটাকে একটু সৃজনশীল করার চেষ্টা করলাম,‘কিছু না হলে এই সকালবেলায় সশব্দে অশ্র“ বিসর্জনের হেতু কী?’

বউ এবার কিছুই বলল না। নিবিষ্ট মনে ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে একের পর এক পেঁয়াজ কাটতে লাগল। বউয়ের হাতের সুনিপুন দক্ষতায় পেঁয়াজ-টুকরো জমা হচ্ছে বটি থেকে বাটিতে।

আমি নিরাপদ দূরত্বে থেকে বললাম,‘কী হল, কাঁদছো কেন? শরীর খারাপ?’

ডানে-বামে মাথা নাড়াল বউ।

‘তাহলে?’

ফোৎ করে একবার নাক টেনে বলল, ‘রাতে খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি।’

আমি এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা টেনশনের বাতাসটুকু নিঃশব্দে ছাড়লাম।

বউ খারাপ স্বপ্ন দেখেছে-এটা আরেক বিপদ। স্বপ্নের ধরনটা কেমন, সেটার ওপর নির্ভর করছে ‘খারাপ’টা কার-ওর নাকি আমার!

গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় আমি মোটামুটি বউয়ের স্বপ্ন-বিশারদ হয়ে গেছি। স্বপ্ন দেখবে সে আর সাফার করব আমি-এটাই নিয়ম বা নিয়তি, মেনে নিয়েছি; উপায় নেই।

বউ যদি স্বপ্নে দেখে, শপিংয়ে যেতে চেয়েছে, আমি টাকা দেইনি-তাহলে সেটা তার জন্য খারাপ বৈকি! আমার জন্য তো ভালো। আর উল্টোটা দেখলে ফলাফলও আমার জন্য উল্টো!

আর যদি স্বপ্নে দেখে, আমি অন্য কোনো মেয়ের হাত ধরে পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছি-সেটা মহাবিপদ!

তবে আজকের সুন্দর সকালটা বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে কয়েকটি পেঁয়াজ। স্বপ্নের ধরন বনাম পেঁয়াজের ঝাঁজ-বউয়ের চোখের জলের পেছনে কোনটার ভূমিকা বেশি-বুঝতে পারছি না। কয়েক সেকেন্ড ভেবে রক্ষণাত্মক জবাব দিলাম, ‘আরে ধুর! বাদ দাও, স্বপ্নে তো মানুষ কত কিছুই দেখে।’

বউ নির্বিকার। ততক্ষণে পেঁয়াজ কাটা শেষ। বউয়ের হাতে বটি ফ্রি হয়ে গেছে! দ্রুত বললাম, ‘লক্ষ্মী সোনা, চোখের পানি মোছ। ড্রইংরুমে আস। আলাপ করি।’

উত্তর বা সম্মতি-অসম্মতির অপেক্ষা করলাম না। সোফায় এসে বসলাম। সোহেলের কথা মনে পড়ল। এসব ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে ওর দেয়া কিছু টেকনিক কাজে দেয়। সে এরকম পরিস্থিতিতে কান্না না শোনার ভান করে অফিসে চলে যায়। রাতে বাসায় ফেরার পর বউ জানতে চাইলে জবাব দেয়-ওহ! তুমি কাঁদছিলে? আমি তো ভেবেছি সকাল সকাল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত-চর্চা করছিলে।

আজ ছুটির দিন। ওই টেকনিক খাটানোর উপায় নেই।

বউ চোখ মুছতে মুছতে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। কান্নার শব্দ কমেছে। হেঁচকি বন্ধ হয়নি।

‘কী হয়েছে, বলবে তো।’

বউ উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল, ‘আজ কত তারিখ?’

‘কেন? ১২ মার্চ।’

‘তো?’

‘তো-তো... মানে?’ আমি তোতলাত থাকি।

‘আজকের কথা তোমার মনে নেই? ইঁ-ইঁ-ইঁ...’ কান্নার ভলিউম বাড়ল হঠাৎ, ‘আজ না আমাদের হাত ধরা দিবস। ভুলে গেছ?’

‘কী? আজ হাত ধোয়া দিবস!’ আমি সত্যি অবাক হলাম।

‘ইঁ ইঁ ইঁ..., তুমি এখনও আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছ? ১২ বছর আগে, আজকের এই দিনে তুমি প্রথম আমার হাত ধরেছিলে। বিয়ের পর থেকে গত নয় বছর এ দিনে ঠিকই সকালে ঘুম থেকে উঠে তুমি আমার হাত ধরেছ। আর আজ? ইঁ ইঁ ইঁ...!’

‘আহ-হা, টাইমই তো দিলে না। ঘুম ভাঙতেই দেখি তুমি পাশে নেই...’ বলতে বলতে বউয়ের হাত ধরতে যাই।

সে দু-কদম পেছায়। আমি এর মধ্যে পাশের রুমে উঁিক দেই। আজ স্কুল নেই। আমাদের ছেলে-মেয়ে দু’জন ঘুমাচ্ছে। আমি হাতের কাছে থাকা টিস্যুবক্স থেকে একটা টিস্যু নিয়ে বলি, ‘চোখের পানি মোছা। শোনো, আজ যেহেতু অফিস নেই, চলো রাতে চায়নিজ খেয়ে আসি। আর অনেকদিন হল তুমি শপিং-টপিংও করো না...’

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই চট করে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল বউ। রীতিমতো ঝলমলে কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে। তুমি যখন এত করে বলছ তাহলে যাই, নাস্তাটা বানিয়ে শপিংয়ের লিস্টটা করে ফেলি।’

‘শপিং’ শব্দটা যে ম্যাজিকের মতো কাজ করবে-ভাবিনি। বউ বেমালুম ‘হাত ধরা দিবসে’র কথা ভুলে গেছে। এদিকে, মাসের মাঝামাঝি হুট করে আসন্ন শপিংয়ে কথা চিন্তা করে মনটা হু হু করে ওঠে আমার। হাতে ধরা টিস্যু ভিজে যায় আমারই চোখের জলে।

এই অশ্রুপাত মানিব্যাগের চিন্তায় নাকি পেয়াজের ঝাঁজে-নিজেই বুঝতে পারি না।

খায়রুল বাবুই: লেখক ও নির্মাতা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম