রম্যগল্প
আন্টি যখন ফেসবুকে
জান্নাতুল ফেরদৌস লাবণ্য
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পাশের বাসার আন্টি নতুন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেই ফোন হাতে চলে এসেছেন আমাকে বন্ধু তালিকায় নেওয়ার জন্য। ফেক আইডিতে রিকোয়েস্ট দিয়ে অ্যাড করে নিতেই খুশি মনে ফিরে গেলেন। দিন তিনেক পর মুখ গোঁজ করে বাসায় এসে বললেন, ‘এই আইডি তোর?’
আমি সরল গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘কই তুই নাকি ফেসবুকে লেখালেখি করিস, আমি তো পাই না।’
আমি মাথা চুলকালাম। আন্টি বললেন, ‘চালাকি কম করে আমাকে আসল আইডি থেকে অ্যাড কর।’
আমি অপ্রসন্ন মুখে রিকুয়েস্ট পাঠালাম কিন্তু অ্যাক্সেপ্ট করলেন না। পরিচিত মানুষজন এই আইডিতে সাধারণত ঢোকাতে চাই না।
আন্টি এরমধ্যে পরপর কয়েকবার তাগাদা দিয়েছেন। ছাদে কাপড় মেলতে গেলেই ওপাশের ছাদ থেকে ডেকে বলেন, ‘কী রে, অ্যাক্সেপ্ট করস না কেন?’
আমি সরল গলায় বলি, ‘কোথায় জানি হারিয়ে গেছে আন্টি, পাইতেছি না।’
‘আরে আমার নাম লেখ। সৈয়দা হোসনে আরা ফাতিমা।’
‘জি লিখতেছি।’
বাসায় চলে আসি। কদিন পর আবার ডাক দেন, ‘আরে পাসনি? হলুদ কালারের শাড়ি, নেভি ব্লু হাতাকাটা ব্লাউজ।’
এরপর আমার সব চাল ব্যর্থ করে একদিন আমার ফোন হাতিয়ে নিয়ে নিজেই রিকুয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করে নিলেন। মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম।
নতুন একটা প্রোফাইল পিক দিয়েছি। আন্টি লাইক দিয়ে কমেন্ট করলেন, ‘এই ছবি কবে তুললি?’
আমি রিপ্লাই দিলাম, ‘এই তো আন্টি, কলেজে অনুষ্ঠান ছিল।’
আন্টি রিপ্লাই দিলেন, ‘কই? আমার ননদের মেয়েরে তো বেরোতে দেখলাম না! কবে ছিল অনুষ্ঠান? একই তো কলেজ! আর তোর ওড়না তো একসাইডে চলে গেছে। তারপর মনে হচ্ছে ইস্তিরিও নাই! চুল তো মুখের ওপরে পড়ছে!’
আমি আন্টির সঙ্গে দেখা করে বললাম, ‘আন্টি, পাবলিক পোস্টে এসব বলা লাগে? সামনাসামনি বলা যায় না? তাছাড়া চুল মুখের ওপরে থাকবে এটাই স্টাইল। এন্থেটিক বলে এসব ছবিকে।’
আন্টি মুখ ভেংচে বললেন, ‘এন্থেটিক আবার কী! মুখের ওপর চুল! চেহারা দেখা যায় না!’
আমি হতাশ গলায় বললাম, ‘কমেন্ট ডিলিট দিয়েছি কিছু মনে করবেন না।’
আন্টি বোধহয় কিছু মনে করলেন। কারণ বিরস মুখ করে বসে রইলেন।
ফেসবুকে প্রিয় কবির কবিতার দুই লাইন পোস্ট দিয়েছি। আন্টি তাতেও লাইক দিলেন। কিন্তু কোনো কমেন্ট করলেন না দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এদিকে রাতে খেতে বসে আম্মু বলল, ‘তোর কী হইছে?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কী হবে?’
‘তোর পাশের বাসার আন্টি বলছিল তোর নাকি ব্রেকাপ হইছে? বলল খেয়াল টেয়াল রাখতে যাতে কিছু করে না বসিস! ফেসবুকে নাকি দুঃখের কবিতা লিখিস।’
আমি বজ্রাহতের মতো বসে রইলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে আম্মুকে বোঝালাম, ‘এটা আমি লিখিনি। এক বিখ্যাত কবি লিখেছেন আমি খালি পোস্ট করেছি।’
আম্মু বিরস মুখে বললেন, ‘মনে দুঃখ না থাকলে আর পোস্টই বা করবি কেন? তোর আন্টি ভুল তো কিছু বলেনাই!’
কিছুদিন পর আবার এক কান্ড। এক ফেসবুক ফ্রেন্ড আমার পোস্টে কমেন্ট করেছে, আমি রিপ্লাই দিয়েছি। আন্টি সেই কমেন্টের মধ্যে এসে রিপ্লাইয়ে লিখেছেন, ‘এই ছেলে কে রে? তোর লেখায় এ কমেন্ট করে কেন?’
আমি জবাব না দিয়ে কমেন্টটাই ডিলিট মেরে দিলাম।
আরেকদিন এক সেলিব্রেটির পোস্টে গিয়ে লিখেছি, ‘আই লাভ এভ্রি সিঙ্গেল থিং এবাউট ইউ।’
আন্টি সেটা দেখে আব্বুকেই ডেকে বসলেন, ‘ভাই! ভিনদেশি এক ছেলে! উগ্র পোশাক আশাক। ওই যে সিক্স প্যাক না কী ওইসব আছে। তার ছবিতে গিয়ে লাভ দিয়ে কী সব আপনার মেয়ে লেখে! মুখেও আনতে পারব না!’
আরেকদিন আমার ছবিতে লাভ রিঅ্যাক্ট দেওয়া এক ছেলেকে মেসেঞ্জারে কল দিয়েই বসলেন, ‘অ্যাই ছেলে, তোমার আব্বু কী করে? জানো লাবণ্যর আব্বুর সমাজে কত মান ইজ্জত! মেয়ে না হয় একটু ইয়ে, তাই বলে তুমি কথা বলবা কেন? খবরদার আর যদি কথা বলছ আমার ননদের ছেলে পুলিশে চাকরি করে, এর বেশি আর বললাম না।’
সেই ছেলে আমাকে নক দিয়ে বলল, ‘আপু, এসব কী! সামান্য লাভ রিঅ্যাক্টই তো দিয়েছি! আপনার আন্টি কী না বলল আমাকে!’
আরেকদিন একটা পোস্ট দিতে না দিতেই আন্টির কমেন্ট, ‘বাসায় আয় তো! শাশুড়ির কুঁচি ঠিক করতে হবে। আমি আবার যাইতেছি দেবর আর জায়ের এনিভার্সারি অনুষ্ঠানে। গয়নাগুলো কেমন মানাইছে দেখে যা।’
মনের দুঃখে আমি পোস্ট করাই বন্ধ করে রেখেছি। কিন্তু এভাবে তো দিন চলে না।
একদিন আন্টির বাসায় গেলাম। আন্টি তখন গোসলে। আমাকে বললেন, ‘জীবনে তো আসিস না নিজের থেকে। আজ হঠাৎ কী মনে করে? বোস, হয়ে গছে। একসঙ্গে চা খাব।’
আন্টির ফোন নিলাম, টুক করে আমার আইডি বের করে আনফলো করে দিয়ে চলে এলাম।
আজকাল আন্টি আম্মুকে দেখলেই বলেন, ‘দেখলেন তো! ছেলেমেয়েকে এভাবে চোখে চোখে রাখতে হয়। আপনার মেয়ে কী ছিল আর কী ভদ্র হয়ে গেছে আমি একটু শাসন করতেই। এখন ছবিও দেয় না, পোস্টও দেয় না। এভাবে শাসন করবেন মেয়েকে।’
