Logo
Logo
×

বিচ্ছু

মলাট বৃত্তান্ত

ভুল মানুষের ভূষণ ভাষার দূষণ

ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কী ভাষায় কথা বলিস? বুঝতে তো সমস্যা হয়। * ইউ নো, আমার কোনো সমস্যা হয় না। এটা তো তাদের প্রবলেম! ইউ নো ব্রো!

Icon

শফিক হাসান

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আনিকা তাবাসসুম ভাষায় ভেসে যেতে যেতে আবিষ্কার করে ফেলতে লাগল অনেককিছু। ঘরে-বাইরে ভাষা নানাভাবেই তাকে তাড়ায়, নাড়ায়। গতকাল লোকাল বাসে কী তুঘলকি কাণ্ডটাই না হল। লোকজন কথায় কথায় যেভাবে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ শব্দ ব্যবহার করে, মুখস্থই করে ফেলেছে অনেকেই। একদিন শ্রেণিকক্ষে স্যারও কথাটা বললেন, ‘বুঝলে, আজকাল ডিজিটাল সাংবাদিকতার নামে তুঘলকি কাণ্ড হচ্ছে। অধিকাংশই হলুদ সাংবাদিকতা!’

আনিকা বলল, ‘স্যার, তুঘলকি কাণ্ড বলতে আমরা কী বুঝব?’

বদরাগী স্যার বিপদেই পড়লেন। চোখে-মুখে হতাশা ফুটতে দিলেন না, ‘পড়াশোনা না করলে জানবে কীভাবে! ভারতবর্ষের ইতিহাসটা অন্তত পড়!’

‘সব শিক্ষাবর্ষের ইতিহাসও পড়ব। হলুদ সাংবাদিকতার কথা বললেন, এটা কেমন? লাল বা সবুজ সাংবাদিকতাও আছে?’

শিক্ষক এবার গলা চড়িয়ে বললেন, ‘রংবাজি-মার্কা প্রশ্ন করবে না। এখানে রং চেনানোর ক্লাস নিতে আসিনি। তুমি আজ কী রঙের পোশাক পরেছ সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে?’

পাশ থেকে ফারাহ ফিসফিসিয়ে বলল, ‘সব প্রশ্নের জবাব স্যারেরও জানা নেই।’

লোকাল বাসে বসে কথাটা মনে পড়তেই মুচকি হাসল আনিকা। বিষয়-সাদৃশ্য দেখে মজাও পেল। স্মৃতি মনে পড়ার সঙ্গে বইপত্র পড়ার কী নিদারুণ তফাৎ। হাসিটুকু মিলিয়ে গেল হঠাৎ যাত্রীদের হৈ-হট্টগোলে। একটি মেয়ে আপত্তি তুলেছে, পেছনের সিটের ছেলেটা তাকে বউ সম্বোধন করে গান গাচ্ছে, এটা ইভটিজিং। এদিকে তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে! অভিযোগ খণ্ডাতে গায়ক ছেলেটা বোঝাল, ‘আমি গান গাচ্ছিলাম- বধু কোন আলো লাগল চোখে...।’

মেয়েটা এমন যুক্তিতে চেতল আরও, ‘চোখে লাগে কেন, মুখে লাগতে পারে না?’

‘আর আমিও এটাই বলছি।’

‘কেন, আমি আপনার বিবাহিতা বউ?’

‘দেখুন, এটা রবীন্দ নাথের গান। বধু শব্দের অর্থ বন্ধু; বউ নয়। তেমনি কপোল শব্দের অর্থ কিন্তু গাল। কেউ কেউ কপাল ভেবে ভুল করে!’

নকল বউ আরও ক্ষেপল, ‘ভুল স্বীকার করে স্যরি বলেন। আমি বাংলায় অনার্স; মাস্টার্সও শেষপর্যায়ে। আমাকে শব্দের উৎপত্তি-ব্যুৎপত্তি নিষ্পত্তি শেখাতে আসবেন না।’

‘স্যরি আপা। বুঝতে পারিনি আপনি উচ্চশিক্ষিতা-বধুকে বউ ভাববেন!’

আনিকাও থমকাল একটু। বানানের নামে যে নৈরাজ্য চলছে, বলা তো যায় না ‘অভিধান প্রণেতা, বিক্রেতা ও বানান রক্ষা পরিষদ’ ইতোমধ্যে নতুন কোনো সংস্কার এনেছে কিনা। এনে থাকলে তর্ক করা বৃথা। তাই বলে ছেলেটাকে ছেড়ে দেওয়াও চলে না। নিজের পান্ডিত্যও লুকিয়ে রাখার বস্তু নয়।

আনিকা দৃষ্টি আকর্ষণ করল, ‘এক্সকিউজ মি, ব্রাদার! শিক্ষিতা শব্দের মানে কী? আপনি জানেন না বাংলাদেশ লিঙ্গ সমতা অর্জন করছে? অধ্যাপকের বিপরীতে অধ্যাপিকা, কবির বিপরীতে মহিলা কবি, শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষিকা বর্তমানে ভুল প্রয়োগ? নারীদেরও স্যার ডাকার বিধান জারি রয়েছে।’

দ্বিমুখী হামলা সামলাতে ব্যতিব্যস্ত ছেলেটি বলল, ‘আপনি আবার কোন কলেজে বাংলা পড়ান?’

‘বাংলা পড়াই না, পড়িও না। মাতৃভাষাটা জানার চেষ্টা করি। আফটার অল, আমাদের ‘ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’ কম চেষ্টায় আসেনি!’

‘পিতৃভাষা বরাবর অবহেলিতই থাকবে?’

ভাড়া কাটতে এসে কন্ডাক্টর ক্যাচাল দেখে বিরক্তি প্রকাশ করল, ‘গাড়ি থেইকা নাইমা আপনেরা সিএনজির পিছনে লেখা কতাডা পইড়া লইয়েন। ভালোবাসা বাড়িতে গাড়িতে নয়।’

‘মানে কী? তুমি কন্ট্রাক্টর নাকি কনসালটেন্ট!’ বাংলায় অনার্স আপা তেড়ে উঠল আবার।

গায়কের নীরবতা দেখে সরব হলো আনিকা, ‘শব্দটা কন্ডাক্টর, কন্ট্রাক্টর নয়।’

আকর্ণ বিস্তৃত হাসি হেসে কন্ডাক্টর বলল, ‘ওই শব্দ এখন আর চলে না, আপা। নতুন নাম পাইছি সুপারভাইজার! বাসের সিটগুলায় চাইয়া দেখেন, কী লেইখা রাখছে!’

আনিকা খেয়াল করল ওর সামনের আসনের পেছনটায় লেখা- রফিক+রুমা। ডানদিকেও লেখা আছে- তমাল+পিয়াসা। সবই যোগ অংক, গুণ-বিয়োগ কোথায়! একটু ভাবতেই জবাবটা পেয়ে গেল। প্রেম কখনোই মাইনাস হয় না। যার প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা চলে যায়, সে আরেকটা জুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। অতীত মনে রেখে ভেউভেউ করে কাঁদে না। আজকালকার দিনে কেউ দেবদাস হতে চায় না, উলটো দাস বা দাসি বানিয়ে রাখতে চায় ‘প্রতিপক্ষ’কে।

রাগের পরেই অনুরাগের দেখা মিলল। অনার্স আপা গন্তব্যে নামার আগে ফোন নম্বর দিয়ে গেল গায়ক ভাইকে। সেটা দেখে কন্ডাক্টর বলল, ‘আগে আছিল ১২০০, আইজ থিকা ১২০১।’

আনিকা বলল, ‘কীসের সংখ্যা এটা?’

‘বিয়া আর প্রেমের। আমার বাসেই সবচাইতে বেশি প্রেম অয়!’

‘ব্যাটা ৪২০!’

‘আমারে ফোর টুয়ান্টি গালি দিলেন?’

‘আরে না! ৪২০টা প্রেম-বিয়ের সাক্ষী তো আমি নিজেই!’

‘আপায় দেখতাছি আমার চাইতেও বড় চাপাবাজ! আপনের ভাড়া দেওন লাগব না।’

‘আচ্ছা, দিলাম না। এখন তোমার ফোন নম্বরটাও আমাকে দাও। জিরো... ওয়ান... এসব বলবে না। পুরোটাই বাংলায় বলবে! পারবে না?’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম