মলাট বৃত্তান্ত
বনে যখন লাগল আগুন প্রহরীদের ঘুমের ফাগুন
আগুন লাগার চারদিন পর টের পেল! কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন ব্যাপারটাকে? * সব দোষ আগুনের! চারদিনে একটা খবরও জানাতে পারল না!
শফিক হাসান
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এমন আবিষ্কারে যারপরনাই বিরক্ত হলো বন-প্রহরীরা। দেশের সবচেয়ে সুন্দর ও বড় বনটিতে রহস্যময় আগুন লাগল, দেরিতে হলেও চৌকস বাহিনীগুলোর তৎপরতায় পানি ঢেলে নিয়ন্ত্রণে আনা হলো। কোথায় প্রহরী ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দেবে; উলটো ছোড়া হচ্ছে উটকো প্রশ্ন-আগুন লাগার চার দিন পর কেন বিষয়টা নজরে পড়ল সংশ্লিষ্টদের। চার দিন সবাই ঘুমিয়েই কাটিয়েছে! যেন ঘুম অপরাধের বিষয়; পৃথিবীতে সুখনিদ্রা নিষিদ্ধ!
প্রচার ও অপ্রচার মাধ্যমগুলো বরাবরই এক ধরনের অনুকরণপ্রিয়তার পরিচয় দেয়। কোনো একটি প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট বিষয়কে সামনে আনলে সতীর্থরাও উঠে পড়ে লাগে ওই বিষয় নিয়েই! অথচ স্বাভাবিক সময়ে তারাও বন-জঙ্গল ও অন্যান্য বিভাগের ঊর্ধ্বতনদের মতোই গভীর ঘুমমগ্ন থাকে।
প্রধান বনপ্রহরীর মেজাজ খিঁচড়ে গেল সাতসকালেই। এক টিকটকার সাংবাদিক কল দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আগুন লাগার চার দিন পর আপনারা খবর পেলেন! নেভানোর এন্তেজাম করলেনও পরে। এ বিলম্বে আপনার অনুভূতি কী?’
অনুভূতি তো ব্যাপক মারাত্মক! মুখে না বলে হাতে-কলমে দেখাতে পারলেই ভালো হতো। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্নটা সয়ে গেলেন তিনি। আরও কত প্রশ্ন যে আসবে ধীরে ধীরে! অতীতে বালিশের ভেতরে, তোশকের নিচে, চালের ড্রামে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা মিলেছিল জনৈক বনখেকোর। তাকে নিয়ে কত মাতামাতি। অথচ লোকটাকে রাক্ষস বলা হলেও মানুষই ছিলেন, অন্য সবার মতোই ভাত মাছ মাংস খেতেন। বিষয়টা এমন নয়-সাধারণ মানুষ খায় এক ছটাক আর তিনি এক মণ!
কিছুক্ষণ পর আরেকজন ইউটিউবার সাংবাদিক প্রশ্ন করল, ‘আপনারা কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমান নাকি!’
কুম্ভকর্ণ? সেটা আবার কে রে বাবা! ঘরে থাকা যৎকিঞ্চিত বই সামনে নিয়ে বসলেন প্রধান বনপ্রহরী। কী আশ্চর্য, কোথাও কুম্ভকর্ণের দেখা নেই। তবে রাশিফল দেখার বইটিতে কুম্ভ রাশির দেখা মিলল। কিন্তু এই রাশির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আগুন লাগার সাযুজ্য পাওয়া গেল না। বাকি থাকল কর্ণ। শৈশবে অপরাধ করলে শিক্ষকরা বলতেন-কর্ণ ধারণ কর! তারপর কান ধরে উঠবস করানো হতো। সেই কুম্ভের সঙ্গে এই কর্ণের কোনো যোগসূত্র মিলছে না। হদিস না পেয়ে বিরক্ত বনপ্রহরী গান ভাজার চেষ্টা করলেন-পিরীতের আগুন/ জ্বলে দ্বিগুণ...।
দুই.
দেশের এক প্রান্তে আগুন লাগলে, অন্য প্রান্তেও লেলিহান শিখা হয়ে খবর ছড়াতে সময় লাগে না। এ অঞ্চলে মেডিকেল থাকলেও প্যারামেডিকেলের কদরই বেশি। ওষুধ বিক্রেতাদেরই ডাক্তার জ্ঞান করা হয়। তাই বোধকরি স্বর্ণলতা মেডিসিন স্টোরে দিনরাত রোগীরা ভিড় বাড়ায়। এখানকার চিকিৎসার সুবিধা হচ্ছে-ডাক্তার ফি দিতে হয় না। টেস্ট-ফেস্টের ঝামেলাও নেই। বললেই রোগের বৈশিষ্ট্য বুঝে ওষুধ দেন দোকানমালিক। ইদানীং অনিদ্রার রোগী বেড়েছে। কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। সবাই চায় আরও কড়া ডোজ! এমন ওষুধ বাজারে থাকলে তো দেবেন। রোগী-ঘোষিত ডাক্তার দিশমিশ না পেয়ে পরামর্শ দেন, ‘সুন্দর বা অসুন্দর কোনো বনে চলে যান। বনপ্রহরীরা কীভাবে ঘুমায় জানুন। ওষুধ ছাড়াই আরোগ্য মিলবে!’
লোকালয় থেকে বন কতদূরে, যাওয়া সহজ নাকি! রোগীদের মোচড়ামুচড়ি দেখে ডাক্তার বলেন, ‘আপনারা বেশি বেশি ওষুধ খেয়ে ভাতের ওপর চাপ কমাচ্ছেন। এটা ভালো দিক। তবে এখন থেকে আগুন-পানির গুরুত্বও বুঝতে হবে। আগুন লাগলেই পানির প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায়। সুতরাং মনের ভেতর নিরাপদ আগুন জ্বালাতে হবে। এই আগুনে যদি কারও সংসার জ্বলেপুড়ে যায়, নিশ্চয়ই অনিদ্রা থেকে মুক্তি মিলবে। অনিদ্রার প্রধান শত্রু দুশ্চিন্তা। আর দুশ্চিন্তার বড় কারণ সংসারকর্ম!’
রোগীরা একমত হয়ে বিদায় নেন। প্রবাদের যথার্থতা নিয়েও ভাবেন-বনপোড়ার মধ্যে কেউ আলুপোড়া দিতে পেরেছিল কিনা, সিগারেট ধরাতে সমর্থ হয়েছে কিনা! কাগজ থেকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যখন উধাও হতে চলেছে, তখন ভরসার জায়গা তদন্ত প্রতিবেদন। যে কোনো বড়োসড়ো ঘটনায় তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন দেয়-সেটা কত চমৎকার বিনোদনই না দেয়। হাস্যরসের দন্তহীন তদন্ত প্রতিবেদনগুলো কবে আসবে-অসুখী রোগীরা অপেক্ষা করে!
তিন.
নিরানন্দ পরিস্থিতির মধ্যেও সুখস্বপ্ন দেখেন প্রধান বনপ্রহরী। এতদিনে জানা হয়ে গেছে, বন হচ্ছে প্রজেক্টনির্ভর বিভাগ। বরাদ্দকৃত টাকা এলেই নয়-ছয়ের আয়োজন কিংবা ভাগাভাগির সুযোগ মেলে। নতুন করে আগুন-সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব দিলে কেমন হয়? এমনটি করা গেলে নিশ্চয়ই ব্যাংকে আরেকটা সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। বনপ্রহরীর মনে পড়ে, শৈশবে হাত দেখানো জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী, ‘এই ছেলে বড় হয়ে বাদশা-জাতীয় বিরাট কিছু হবে।’
অজান্তে মুখে হাসি ফোটে বনপ্রহরীর। ধীরলয়ে স্বগতোক্তি করেন, ‘কাটিব বৃক্ষ খাইব সুখে!’
তারপর ধরেন সুখের গান-আইল দারুণ ফাগুনরে/ লাগল মনে আগুনরে...।
shafique_hasan79@yahoo.com
