|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শাকিল আমাদের বন্ধু। এই বয়সেই পাকা ব্যবসায়ী বনে গেছে। ফেনী শহরে বিরাট ঘড়ির দোকানের মালিক। দোকানের নাম মিতালী ওয়াচ।
বন্ধুর ঘড়ির দোকান থাকলে যা হয়। আমরা দেশের বা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন ঘড়ি কিনি শাকিলের দোকান থেকেই। এমনকি ঘড়ি নষ্ট হয়ে গেলেও সেই নষ্ট ঘড়ি হাতে নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াই। অপেক্ষায় থাকি- কখন ফেনী যাবো, কখন শাকিলের দোকান থেকে ঘড়ি কিনব। বন্ধু ঘড়ির ব্যবসা করে সুতরাং তার দোকান থেকে ঘড়ি কেনা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শাকিলের কাছ থেকে ঘড়ি কিনতে গিয়ে আমাদের প্রথম শর্ত, ‘আরে ভাই ঘড়ি কিনতেই আসছি, তোর চেহারা দেখার জন্য আসিনাই। জলদি চা-কপি কিছু অর্ডার কর।’ বন্ধু বিরস বদনে চায়ের অর্ডার দেয়। কপির ধারে কাছে ঘেঁষে না।
তারপর চা খেতে খেতে দ্বিতীয় শর্ত, ‘দোকানে যত হাত ঘড়ি আছে একটা একটা করে সব দেখাবি। চিপাচুপা যেখানে যা আছে সব। টাকা দিয়া ঘড়ি নিমু দেখেশুনে নিমু।’
বন্ধু পাল্টা প্রশ্ন করে,‘ঘড়ি কি একটাই নিবি না একডজন?’
‘একডজন মানে! মানুষ এক হাতে কয়টা ঘড়ি পরে?’
‘আমি তো জানি একটাই পরে।’
‘এই তো লাইনে এসেছিস। ঘড়ি একটাই নিমু! সবসময় খালি পুশিং সেলের ধান্দায় থাকিস। এখনও সময় আছে, ভালো হয়ে যা। সৎ পথে ব্যবসা কর। দেখবি ব্যবসায় তরতর করে উন্নতি হচ্ছে। আর কাস্টমারকে ঠকানোর চিন্তা করলে দেখবি ব্যবসায় লাল বাত্তি জ্বলে গেছে।’
‘না মানে সব নামাতে বললি তো, তাই ভাবলাম হয়তো ডজনখানেক নিবি।’
বন্ধুর টিপ্পনী গায়ে না মেখে বললাম, ‘কথা এত প্যাঁচাবি না তো। জলদি সব বাইর কর।’
শাকিল একের পর এক ঘড়ি বের করতে থাকে, আর আমরা একের পর এক দেখতে থাকি। দেখতে দেখতে বলি, ‘যে ঘড়িই কিনি ঘড়িতে সর্বোচ্চ দুই টাকা লাভ করবি। এর বেশি লাভ করা যাবে না।’
‘চালের কেজি কত জানিস?’ শাকিলের পাল্টা প্রশ্ন।
‘আমার তো এত কথা জানার দরকার নাই। আমি চাল কিনতে আসি নাই। ঘড়ি কিনতে আসছি, ঘড়ি বেচবি ব্যস।’ দেখতে দেখতে একটা পছন্দ হয়ে গেল। দাম জানতে চাইলাম। বন্ধু দাম হাঁকাল,‘এক হাজার টাকা।’
‘মানে কী! এই ঘড়ির দাম এক হাজার টাকা ক্যামনে হয়! তুই ভদ্রলোক না ডাকাত!’
‘আরে ভাই আটশ টাকা আমার কেনা আছে। অন্য কাস্টমারের কাছে এই ঘড়ি পনেরশ টাকার ওপরে বেচি। তোরা বন্ধু মানুষ তাই কমিয়ে বললাম।’
‘চাপাবাজি রাখ। এই ঘড়ি দুইশ টাকার বেশি এক পয়সাও পাবি না।’
‘ভাই, চা খাইছস ভালো কথা। দরকার হইলে আরেক কাপ খা। আমি টাকা দিমু। আমার দোকান থেকে তোদের ঘড়ি কিনতে হবে না। অন্য দোকান দেখ।’
‘মানে কী রে ভাই! আমাদের কাছে ঘড়ি বেচবি না? আমাদের তোর কাস্টমার মনে হয় না? তুই তো বন্ধু নামের কলঙ্ক। ছিঃ! ঘেন্না!’
‘আরে ভাই তোদের কাছে ঘড়ি বেচব না তো বলিনাই। ঘড়ির একটা ন্যায্য দাম আছে। সেটা তো দিতে হবে। আমি লসে বেচব নাকি! এক হাজার টাকার ঘড়ি দুইশ টাকায় কাউকে বেচতে দেখেছিস? অন্য দোকানে গিয়া দেখ। আমারে বিরক্ত করিস না। এই ঘড়ি যদি এক হাজার টাকার নিচে কেউ বেচে আমি ঘড়ির ব্যবসা ছাইড়া বিড়ির দোকান দিমু।’
‘আচ্ছা যা, আরও বিশ টাকা নিস। মোট দুইশ বিশ টাকা। এরপর কথা বলবি কানের গোড়ায় একটা দিমু।’
শাকিল হতাশ দৃষ্টিতে তাকায়। অন্য বন্ধুরা মিটমিট করে হাসে। আমি ক্ষোভের সুরে বললাম,‘তুই একটা অমানুষ! তোর দোকান থেকে ঘড়ি নিমু বলে ঢাকা থেকে ঘড়ি কিনিনাই। তোর মধ্যে তো কোনো কৃতজ্ঞতা বোধই নাই। যাই হোক, ঘড়ির ওয়ারেন্টি কত বছরের?’ বলতে বলতে ঘড়িটা শাকিলের চোখের সামনে সরল দোলকের মতো এদিক-ওদিক দোলাতে থাকি।
‘এক বছর।’
‘এক বছর মানে! এক বছর ওয়ারেন্টি তো রহিম, করিম সবাই দেয়। তুই আর আমাদের বন্ধু হলি কেন? কম করে হলেও পঞ্চাশ বছরের ওয়ারেন্টি দিবি! বন্ধুর জন্য এইটুকু করতে পারবি না!’
‘কোনো ঘড়িতে পঞ্চাশ বছরের ওয়ারেন্টি দিতে কখনও শুনেছিস? আর দিলেও আরও পঞ্চাশ বছর আমি বাঁচবো না তোরা বাঁচবি?’
‘না বাঁচলে নাই। তাই বলে আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবো কেন? দরকার হলে ছেলেমেয়ের হাতে ওয়ারেন্টি কার্ড দিয়া যামু। ওরা বুইঝা নিব।’
এ বেলায় রাগে-দুঃখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে শাকিল। পাশ থেকে আমাদের অন্য বন্ধু আরিফ ফোড়ন কেটে বলে, ‘তোর মাথা ঠিক আছে তো? পঞ্চাশ বছরের ওয়ারেন্টি কোনো ওয়ারেন্টি হল! মিনিমাম আশি বছর দিতে হবে।’
আরিফকে থামিয়ে দিয়ে বলি,‘থাক, ওর দিকটাও তো দেখতে হবে। ওর তো ব্যবসা এটা। বন্ধু হয়েছি বলে তো আর অন্যায় কিছু দাবি করতে পারি না।’ বলতে বলতে ঘড়িটা হাতে দিয়ে উঠে পড়ি।
‘কী হল, উঠলি যে! টাকার কথা কিছু তো ফাইনাল হল না!’
‘আবার কী! বললাম তো দুইশ বিশ! আর ভালো কথা, প্রতি তিন মাস পরপর মনে করে ব্যাটারি পাল্টে দিবি। মনে থাকে যেন।’
‘কেবল ব্যাটারি না, ঘড়িও পাল্টে দিমু।’ রাগে গজরাতে থাকে শাকিল। আমরা ততক্ষণে সামনের দিকে পা বাড়াই।
‘তোরা সব যাচ্ছিস কই? ঠিক আছে, দুইশ বিশ টাকাই দে।’ এবার পেছন থেকে ভেসে এলো শাকিলের কাতর কণ্ঠ।
‘এখন নাই। বাকির খাতায় লেইখা রাখ, পরে দিমু।’ নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিই আমি।
‘এক হাজার টাকার ঘড়ি দুইশ বিশ টাকায় দিচ্ছি তাও আবার বাকি! তাও আবার পঞ্চাশ বছরের ওয়ারেন্টি! তার ওপর আবার তিন মাস পরপর ব্যাটারিও পাল্টে দিতে হবে!’ বলতে বলতে শাকিল ধপাস করে সিটে বসে পড়ল।
আরিফ আবার পেছন ফিরে ফোড়ন কেটে বলল,‘বেশি গরম লাগলে ফ্যানটা একটু বাড়িয়ে দে।’
আমি ততক্ষণে বিড়বিড় করে একটা গানের সুর ধরি, বন্ধু আমার ঘড়ির দোকানদার...!
পরদিন শাকিলের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে দেখি একটা ঢাউশ সাইনবোর্ড ঝুলছে। সেখানে বড় করে লেখা ‘এখানে বন্ধু-বান্ধবের কাছে কোনোরকম ঘড়ি ক্রয়-বিক্রয় হয় না। ধন্যবাদ’!
বললেই হবে নাকি! এরপরও আমরা ঘড়ি কেনার জন্য দেশের বা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি আমাদের বন্ধুর দোকানে গিয়েই হাজির হই। ঘড়ি আমাদের মিতালী ওয়াচ থেকেই কেনা চাই।
ইমন চৌধুরী : লেখক ও সাংবাদিক।
