মলাট বৃত্তান্ত
দুর্নীতি মানে দূরের নীতি
কাট! স্যার, টাকা দেয়ার সময় সুন্দর করে হাসি দিবেন!
সত্যজিৎ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম’ খবরটা দেখে মোবাইল ফোনের দিকে আরও একটু ঝুঁকে পড়লেন রুমালদা।
‘কী ব্যাপার, কোনো গুপ্তধন, টুপ্তধন পেলেন নাকি? সেই তখন থেকে মোবাইল খুঁড়েই যাচ্ছেন!’ চমকে উঠে পাশে তাকালেন রুমালদা। অফিসে পাশের ডেস্কে বসা শিপন সাহেবের হাতে মোবাইল ফোনটা তুলে দিলেন। শিপন সাহেব এক নজর দেখে বললেন, ‘আরে তাই তো, একটা শূন্য বেশি পড়ে গেছে মনে হচ্ছে। দুর্নীতিতে আমরা না প্রথম ছিলাম?’ রুমালদা চোখ বড় বড় করে শিপন সাহেবের দিকে তাকালেন।
‘যে দেশের টপ টু বটম সবার অবাক করা সব দুর্নীতির খবর ফাঁস হয়, সে দেশের রেজাল্ট এতটা খারাপ হতে পারে?’ শিপন সাহেবের কথায় রুমালদা ফিরে গেলেন তার ছোটবেলায়। হাফপ্যান্ট পরা রুমালদার তখন মনে হতো দূরের নীতিকেই বুঝি দুর্নীতি বলে। সপ্তাহে একদিন রিকশায় বাবা-মায়ের কোলে বসে ঘুরতে যাওয়াই ছিল তখনকার সেরা বিনোদন। পাশ দিয়ে যাওয়া মোটর গাড়ির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকা দেখে বাবা বলত, ওদিকে ভুলেও তাকাবি না। ওগুলো দুর্নীতির টাকায় কেনা। তখন মনে হতো দুর্নীতির টাকায় চলা গাড়ি বুঝি অনেক দূর দিয়েই চলে। সে ধারণা ভুল প্রমাণ করতেই একদিন বাড়ির গেটে দেখা গেল ঝকঝকে এক গাড়ি। প্রতিবেশী আঙ্কেল নতুন গাড়ি কিনেছেন, সেটা দেখাতেই এসেছেন বাড়িতে। আঙ্কেল চলে যেতেই মা মুখ ফুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল বাবাকে, ‘করে তো সরকারি চাকরি, এত টাকা আসে কোথা থেকে?’
মুখের কাঁচা-পাকা দাড়িতে হাত রেখে বাবা উত্তর দিল, ‘আর বলো কেন? ওদের ডিপার্টমেন্টে দুর্নীতিই তো নীতি! ঘুস তো বাতাসে ওড়ে, খপ করে ধরে নিলেই হলো।’
শুনে খুব অবাক হয়েছিল রুমালদা। সত্যি ঘুস উড়ে বেড়ায়? খপ করে ধরে নিলেই হয়! এ কী রূপকথা?
কালের নিয়মে সবাই বড় হয়ে যায়। রুমালদাও হয়েছে। রুমালদার মাঝে মধ্যেই সন্দেহ হয়, আসলেই কী সে হয়েছে? তাহলে তার মাথায় বোকা বোকা প্রশ্ন আসে কী করে? এ দেশের প্রতিটা মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তাহলে দুর্নীতির পক্ষে কারা? যদি দুর্নীতির পক্ষে কেউ না-ই থাকে, তাহলে দুর্নীতি করছে কারা? আর যদি এ দেশের কোনো মানুষ দুর্নীতি না-ই করে, তবে বারবার দুর্নীতির তালিকায় আমরা উপরের দিকে থাকছি কী করে? এ অদৃশ্য অদ্ভুত বদভূতের কাছে আমরা প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছি কেমন করে?
গালে বসা মশা হুল ফুটিয়ে বাস্তবে ফেরায় রুমালদাকে। আহ্ বলে শিপন সাহেবের দিকে তাকালেন রুমালদা।
‘এটুকু শুনেই ‘আহ্’ করে উঠলেন? বিশ্লেষকরা কী মনে করছে জানেন?’ শিপন সাহেব একবার আড়চোখে রুমালদাকে দেখে তার মোবাইলের গুগুল মামার ভান্ডার থেকে খবর তুলে এনে পড়া শুরু করলেন, ‘বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে তা দেশে বিশাল দুর্নীতির হিমশৈলের সামান্য অংশ মাত্র। তারা বলছেন, সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো এখন যাদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ হচ্ছে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থেকে দুর্নীতি করছেন। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই এ দুর্নীতি তাদের অধস্তন পর্যায়ে সঞ্চারিত হয়েছে। তারা ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এ দুর্নীতি করেছেন।’
‘মানতে পারলাম না এ খবরটা। ভালো করে দেখেন তো খবরের তারিখটা কবে?’
তারিখটা পড়ে জিহ্বায় লম্বা একটা কামড় দিলেন রুমালদা। যাক বাবা, আগের বছরের রিপোর্ট। এবার নিশ্চয়ই এতটা খারাপ হবে না ফলাফল।
অফিস শেষে রিকশায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে পাশে বসা শিপন ভাইয়ের কাছে সুপ্ত মনের গুপ্ত প্রশ্নটা করেই ফেললেন রুমালদা, ‘আই এম লুকিং ফর দুর্নীতিবাজ। এ দেশে দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা কত হতে পারে, ভাই?’
রিকশায় পাশে বসে থাকা শিপন ভাই কিছু বলার আগেই রিকশাওয়ালা নব্বই ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘এইডা কুনো বিষয়? এ ঢাহা শহরে কে কয় টেহা বেতন পায়, আর কয় টেহার ঘরে থাহে এইডা দেকলেই তো বাইর অইয়া পড়ে নীতিবান মানুষ কয় পিস আছে!’
