রম্য গল্প
বাচ্চাটা জন্ম দিল কে?
রিয়াজুল আলম শাওন
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাত দুপুরে হুট করে ঘুম ভাঙলে আমার মাথা কাজ করে না। সবকিছু বুঝে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। ইদানীং ঘুমালেই শুধু খাওয়ার স্বপ্ন দেখি, বার্গার, পিজ্জা, চাওমিনসহ আরও কত কী। আজ স্বপ্ন দেখছিলাম এক কামড়ে একটা বার্গার সাবাড় করছি। একটু পর স্বপ্নটা বদলে গেল। দেখলাম আমিই একটা আস্ত বার্গার হয়ে গেছি। এখনই কেউ একজন আমাকে কামড় দিয়ে ফেলবে। স্বপ্নের মধ্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। কেউ একজন বড় একটা কামড় বসাল। আমি ‘আউ’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। ঘুম ভেঙে গেল। ঘাড়ের কাছে ব্যথা করছে। সম্ভবত ঘাড়ে কেউ কামড় বসিয়েছে। একটু পর একটা কাতর ধ্বনি শুনতে পেলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম কেউ একজন আমার পাশে বসে শব্দ করছে। মানুষটা সোনিয়া। সোনিয়ার হাত আমার কাঁধে। মুখ দিয়ে কেমন যেন শব্দ করছে সোনিয়া। আমি বললাম, ‘কী হল ঘাড়ে কামড় দিলে কেন?’
সোনিয়া কাতরাতে কাতরাতে বলল, ‘ইডিয়ট। ঘাড়ে কামড় দেইনি। নখ নিয়ে খামছি দিয়েছি।’
ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বললাম, ‘তা খামছিই বা দিলে কেন?’
সোনিয়া বহু কষ্টে বলল, ‘তোমার ঘুম ভাঙছিল না কোনোভাবেই, তাই...।’
‘কী হয়েছে তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?’
সোনিয়া প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘ব্যথা উঠেছে। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও।’
‘ব্যথা? কীসের ব্যথা?’ আমার মাথা কাজ করছে না। মনে হচ্ছে এখনও স্বপ্ন দেখছি।
সোনিয়া রেগে বলল, ‘আম্মাকে ডাকো। আমি মারা যাচ্ছি। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও।’
সোনিয়া ছটফট করতে লাগল। এবার আমি বুঝতে পারলাম। আমাদের সন্তান জন্মের সময় হয়ে গেছে, সোনিয়াকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
হাসপাতালে নেয়ার পর সোনিয়ার ব্যথাটা আরও বাড়ল। ডাক্তার বলল, ‘নর্মাল ডেলিভারিই হবে।’
আমার চোখ মুখ শুকিয়ে গেল। ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। ডাক্তারের নাম মুনিমা জাহান। তিনি বললেন, ‘আপনি এত নার্ভাস হচ্ছেন কেন? মানুষের বাচ্চা হয় না?’
আমি চেয়ারে চুপচাপ বসে রইলাম। আব্বা আর দুলাভাই দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন।
হঠাৎ নার্স এসে বলল, ‘আসেন আপনি আসেন।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাব?’
‘অপারেশন থিয়েটারে। রোগীর পাশে থাকবেন।’
‘আমি কেন থাকব?’ গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না আমার।
‘রোগী চাইছে আপনি তার পাশে থাকেন।’
আমি বারবার ঢোক গিলতে লাগলাম। ‘ইয়ে মানে...।’
‘এত ঘামছেন কেন?’ নার্স জিজ্ঞেস করল।
আমি নার্সের পেছনে হাঁটতে শুরু করলাম।
অপারেশন থিয়েটার। ঠাণ্ডা একটা ঘর। আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। মনে হচ্ছে এরা জোর করে আমার কোনো একটা অপারেশন করিয়ে দেবে, তাই হয়ত আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। সোনিয়া সমানে চিৎকার করছে। বাচ্চা হওয়া এত কষ্টের আগে বুঝিনি। সোনিয়া আমার হাতটা শক্ত করে ধরল। ডাক্তারের হাতে ইনজেকশন। সোনিয়ার চিৎকার হঠাৎ করে বেড়ে গেল। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ধড়াম করে নিচে পড়ে গেলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই।
মনে হচ্ছে ধু ধু মরুভূমির ভেতর আমি হেঁটে বেড়াচ্ছি। কেউ যেন অনেক দূর থেকে আমাকে ডাকছে, ‘রিয়াজুল, ওই রিয়াজুল।’ আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কী ঘটছে।
কর্কশ গলায় নারী কণ্ঠে কেউ একজন বলল, ‘এবার চোখ না খুললে কিন্তু নার্সকে বলে দশ বারোটা ইনজেকশন দিয়ে দেব। ইনজেকশনের ভয় আমার ছোটবেলা থেকেই। আমি কোমায় থাকলেও সম্ভবত ইনজেকশনের ভয়ে জ্ঞান ফিরে পাব।’
আমি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম। অনেক মুখ দেখতে পেলাম। আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। স্যালাইন চলছে।
মা আমার দিকে তাকিয়ে কঠোর বলল, ‘তুই অজ্ঞান হলি কেন?’
আমি কিছু উত্তর দেয়ার আগেই নার্স বলল, ‘যাক ৫ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরেছে।’
সোনিয়ার আম্মা মানে আমার শাশুড়ি বলল, ‘বাবা, এখন কেমন লাগছে?’
ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললাম, ‘মাথা ঘোরে।’
নার্স বলল, ‘শরীর দুর্বল। মনে হচ্ছে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।’
আর একজন অচেনা মহিলা, সম্ভবত সোনিয়ার দিকের কোনো আত্মীয় বললেন, ‘এমন তো কোনোদিন দেখি নাই। বাচ্চা হইল সোনিয়ার, সে দিব্যি ভালো আছে। আর জামাই চিৎপটাং হইয়া হাসপাতালে পইড়া আছে।’
আর বৃদ্ধা মহিলা বলল, ‘ডেলিভারিটা হল কার? সোনিয়ার নাকি জামাইয়ের? হি হি।’ ঘরের ভেতর হাসির রোল পড়ল।
সোনিয়ার আম্মা বলল, ‘আসলে জামাই আমাদের মেয়েকে অনেক ভালোবাসে তো, বউয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারেনি।’
সবাই হাসতে লাগল।
মা বলল, ‘তোর একটা ছেলে হয়েছে। এখনও কোলে নিতে পারলি না।’
মুখে হাসি ফুটল আমার।
বললাম, ‘কোথায় ও? কোথায়?’
‘সোনিয়ার কাছে। পাশের কেবিনে।’
একটু ওঠার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। মাথা ঘুরে উঠল।
মা বলল, ‘থাক। থাক। তোর উঠতে হবে না। সোনিয়া তোর চেয়ে সুস্থ আছে। একটু পর সে নিজেই বাচ্চা নিয়ে এই রুমে আসবে।’
বৃদ্ধা মহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ। সেটাই ভালো।’
এক ঘণ্টা পর সোনিয়া সত্যি আমার কেবিনে আসল। তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না এমন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কোলে একদম ছোট একটা বাচ্চা। এটা আমার সন্তান? সত্যিই আমার সন্তান?
ক্লিনিকে এক বিচিত্র পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। দুনিয়ার আত্মীয় স্বজন আমাকে দেখতে ভিড় জমাচ্ছে। আমার মাকে যেই ফোন করে তাকেই তিনি বলেন, ‘মা এবং বাচ্চা ভালো আছে। শুধু বাচ্চার বাবা একটু অসুস্থ।’
আমার রুমে হরলিকস, জুস, কমলায় সয়লাব হয়ে গেছে। সোনিয়া প্রতিদিন হাসতে হাসতে আমার রুমে আসে। আমার ধারণা আমার পিচ্চি বাচ্চাটাও তার বাবাকে দেখে হাসে। আমি প্রতিদিন ওঠার চেষ্টা করি। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে হয়।
সেদিন ডাক্তার এসে আমার পালস দেখে বললেন, ‘আপনাকে নিয়ে তো মহা মুশকিল হল, ম্যাটারনিটি ক্লিনিকের একটা কেবিন আপনি দখল করে আছেন। অন্য রোগীরা এখন কোথায় যাবে?’
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সোনিয়া আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘এত বড় গর্দভ জীবনেও দেখিনি। বাচ্চা জন্ম দিলাম আমি। আর অসুস্থ হলা তুমি। বাচ্চাটাকে কোলে পর্যন্ত নিতে পারলে না।’
বিড়বিড় করে বললাম, ‘তোমাকে বেশি ভালোবাসি তো তাই তোমার কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারিনি। মনের ওপর খুব চাপ পড়েছে তো তাই এমন অবস্থা।’
‘চুপ করো। এখনই ওঠে দাঁড়াও। আমাকে কাল রিলিজ করে দেবে। তুমি সুস্থ না হলে তোমাকে এখানে ফেলেই চলে যাব।’ সোনিয়া রাগ হয়ে বলল।
সোনিয়ার কথায় মনে হয় কাজ হল। বিকাল থেকেই অল্প বিস্তর হাঁটাহাঁটি করতে পারলাম। বাচ্চাটাকে কোলে নিলাম প্রথমবারের মতো। আহা কী মধুর সে অনুভূতি! হ
