|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বড়বিলা গ্রামের তরিক বখ্শ এলাকার সবচেয়ে বড় গাল্পিক। গল্প বোঝাই তার ভাঁড়ার। তাকে টেক্কা দিতে আর্বিভূত হলেন ওই গাঁয়েরই ছেলে নবাব আলী। বয়সে নবীন হলেও লোকজনকে বিব্রত করতে এই ছোঁকরার জুড়ি মেলা ভার। এই নবাব একদিন তরিক বখ্শকে বললেন, ফুফা, (তরিক বখ্শ গ্রামেই বিয়ে করেছেন। এজন্য গ্রামের অল্প বয়সিদের সম্পর্কে তিনি ফুফা হন। সেই সূত্রে নবাব আলীও তাকে ফুফা ডাকেন) শুনলাম আপনি নাকি ম্যাট্টিক ফেল। সবাই বলা কওয়া করে ছাত্রজীবনে আপনি অঙ্কের জাহাজ ছিলেন। বলেন তো পাঁচ সের চালের দাম কত
তরিক বখ্শ ইতস্তত করে বললেন, চাল কত করে সের বাপু
নবাব তড়িঘড়ি করে জবাব দিলেন, দর বললে তো যে কেউ উত্তর দিতে পারবে। আপনি কত পারেন দর ছাড়া হিসাব করে দেন!
নবাবের কথা শুনে উপস্থিতিদের মধ্যে একটু হালকা হাসির রোল বয়ে গেল।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগে তরিক বখ্শ তার উসকো খুসকো চুলে হাত বুলিয়ে বলতে শুরু করলেন। শোনো বাপু তাহলে এবার। গাল্পিক লোকটির এ কথা শোনার পর সবাই নড়ে চড়ে বসল। ধীর স্বরে কেউ একজন বলে উঠল, এই নে। শুরু হইছে। গাল্পিক সাহেব অবশ্য কথাটি শুনেও না শোনার ভান করলেন। এ মুহূর্তে তার দরকার গল্পটা বলা। শ্রোতাদের মধ্যে শৃঙ্খলা না থাকলে গল্পে মাজেজা থাকে না। এটা সব গল্পকথকই জানেন। অবশ্য তার গল্প সবাই নিমগ্ন হয়ে শোনে।
তরিক বখ্শ শুরু করে দিলেন, কথায় কথা বাড়ে মন্থনে ওঠে ঘি। জ্যৈষ্ঠ মাসের একদিন। দিনটি ছিল রোববার। তালগাছির হাট বসে রোববারে। সে সময় অত্র এলাকার একটাই হাট। করতোয়া নদীর পাড়ের ওই হাটই ছিল পঞ্চাশ গাঁয়ের মানুষের সওদাপাতির একমাত্র ভরসাস্থল। গলা পরিষ্কার তরিক বখশ বলে ওঠেন বুঝছো তো। যা হোক, দিনের প্রথম পহরে পশ্চিমের মাঠের জমি জমিজমা দেখা শেষ করে পুকুর থেকে গোসল সেরে বক্কর সরদার যাবেন তালগাছির হাটে। বউকে বলে গিয়েছিলেন ভাত বেড়ে রাখতে। গোসল সেরেই তিনি যাবেন হাটে। একটুও দেরি করবেন না। বউও তার জন্য সবকিছু প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে গেল। বক্কর সরদারের বউ পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্বামীর দেখা নেই। প্রতিবেশীদের খবর দিলেন তার মিনসাকে দেখছে কিনা। কেউ সঠিক খবর দিতে পারে না। কেউ কেউ বলে অমুক সময় ঘাড়ে গামছা নিয়ে পশ্চিম দিকে যেতে দেখেছি। কেউ বলে, হাট তো পুব দিকে। তা পশ্চিম দিকে গেছে কেন একেকজনের একেক কথা। কেউ বলে দেখ হাটেই গেছে চরা থেকেই। একেবারে বাজার কইরা ফিরবে। বক্কর সরদারের বউ আশায় ছিলেন। সত্যি বুঝি স্বামী তার হাটে গেছেন। সওদাপাতি নিয়ে আসবেন। হাট ফেরত মানুষ এলো। কিন্তু সরদার এলেন না। যারা হাট থেকে ফিরছে। তাদের কাছে বক্কর সরদারের খবর জানতে চাইলেন। দেখছে কিনা। কিন্তু কেউই সদ উত্তর দিতে পারলেন না।
সন্ধ্যা নামল। তার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে রাতের খাবারও বাড়ির সবাই দেরি করে খেলেন। সে রাতে বক্কর সরদার এলেন না। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। সকাল হলো। জ্ঞাতিগোষ্ঠীর আত্মীয় বাড়িতে লোক পাঠানো হলো। কোথায়ও কোনো খবর নেই তার।
এরমধ্যে দুপুর গড়িয়ে গেছে। হঠাৎ বক্কর সরদার বাড়িতে এসে উপস্থিত। বাড়ির সীমানায় পা রাখার আগেই হাঁক ছেড়ে বললেন, ‘দেরি হয়ে গেল রে। তাড়াতাড়ি ভাত দাও। হাটের সময় চলে গেল। তার এ কথা শুনে বাড়ির লোকজন তো থ।’ তার বউ বললেন, ‘আরে লোকটা কয় কি! হাট চইলা গেছে কাল। আর আজ আইসা কচ্ছে হাটে যাবি।’ বউয়ের কথা শুনে বক্কর সরদার বললেন, ‘কও কি তোমরা। আমি তো সকালেই কয়ে গেলাম পশ্চিম চরার পাটের জমি দেখবার যাচ্ছি। সেখানেই যাইয়া ক্ষেতের আইলে বসলাম। একটু ঝিমুনি ধরল। শরীরটা জুড়াইয়া গেল ফুর ফুরে বাতাসে। আইলের পাড়ে গামছাটা পাইতা গা খান এলিয়ে দিলাম। কখন যে ঘুমে ঢলে পড়লাম খেয়ালই করি নাই। ঘুম থেকে জাইগা দেখি বেলা খাড়া। পুকুরে আইসা গোছল দিয়ে বাড়িত আয়া পড়লাম। আর তোমরা কচ্ছ আজ সোমবার।’ এটুকু বলে তরিক বখ্শ খুব জোরে সোরে বলে উঠলেন, বাপু এমনই ছিল বক্কর সরদারের আক্কেল। এই লোকের নাতি হলো নবাব আলী। তার কাছে তোমরা এমন তলফাটা প্রশ্ন ছাড়া আর কিইবা আশা কর। দাদার রেশ তার মধ্যে কিছুটা না থাকলে চলে! নবাব আলী কিছু বলতে উদ্যত হলে লোকজন থামিয়ে দিলেন। রব উঠল থাম। থাম তো নবাব আলী। কি থুইয়া কি কইবা পরে। ফুফা মিয়া আবার উলটা আরেকটা গল্প দিয়ে তোমারে দাবাইয়া দিবি।
