মলাট বৃত্তান্ত
তাল খেয়েছে তিলে কান নিয়েছে চিলে
বল তো, গুজব কী? * গুজব হচ্ছে একটি বায়ুবাহিত সংক্রামক রোগ!
শফিক হাসান
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নিজের নামকরণের সার্থকতা দিতেই বোধকরি রবিউল হোসেন কচি প্রায়ই ছেলেমি কাণ্ডকারখানা করে বসে। লোকে সেটাকে গুজব মনে করলেও সে সোজা-সাফটা ‘জব’ মনে করে। এ জবে বেতন না থাকলে প্রভূত বিনোদন মেলে!
বাজারে গিয়ে দরদাম করে কেনার দক্ষতা সবার থাকে না। কেউ কেউ চায় একদামের ন্যায্য দোকান। নির্দিষ্ট একটা দোকানের বাইরে প্রতিদিনকার দর-তালিকা সাঁটানো থাকে। ক্রেতারা সেটা দেখে বাজেট অনুযায়ী কেনাকাটা করে। ন্যায্য মূল্যের দোকানেও কী একটা সর্বনাশা কাণ্ড ঘটে গেল সেদিন। ২০ টাকা কেজির আলুর দাম লেখা হয়েছে ২০০ টাকা। শুধু আলু নয়, প্রতিটি জিনিসের দামই অস্বাভাবিক বেশি আজ। ক্রেতারা ‘জগের মুল্লুক পাইছসনি’ বলে তর্জন-গর্জন করলে, দোকানদার বাইরে এসে দেখল কোন হতচ্ছাড়া একটা শূন্য বাড়িয়ে আলুর দাম বানিয়েছে ২০০ টাকা! এভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম ঊর্ধ্বমুখী! ব্লেডের দাম ৫০০ টাকা!
হাতাহাতিতে যাওয়ার আগেই বিষয়টা মিটমাট হলো। সাঁটানো তালিকা অপসারণ করল দোকানদার। দূর থেকে কচি এসব দেখছিল আর মিটিমিটি হাসছিল। ওর কাজই সবসময় প্যাঁচ লাগিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মজা দেখা।
সেদিন বরপক্ষের একটা গাড়ি নির্দিষ্ট বাড়িটি খুঁজে পাচ্ছিল না। কচির কাছে খোঁজ জানতে চাইলে বলল, ‘ওইখানে গিয়ে কী করবেন? ওই বাড়ির মেয়ের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গেছে!’
বর বেচারা যেহেতু এতদিনে ফোনালাপে হবু বউয়ের সঙ্গে প্রেম জমিয়ে তুলেছে, সবই নখদর্পণে। কচির কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে বলল, ‘শেরোয়ানি-পাগড়ি পরা আছি, তাই বেঁচে গেলি। নইলে ঠাঁটিয়ে চড় মারতাম!’
কীভাবে যেন সব ঘটনা থেকেই কচি বেঁচে যায়। কেউ তার টিকিটিও ছুঁতে পারে না।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা টিউশনি পাওয়ার নতুন পদ্ধতি ধরেছে এখন। কাগজে নিজের ফোন নম্বর লিখে বিজ্ঞাপন ঝোলায়- ‘পড়াতে চাই’।
কচির কাজ হলো এসব বিজ্ঞাপনের আগে ‘থা’ যুক্ত করে দেওয়া। সেক্ষেত্রে বাক্যটা হয় ‘থাপড়াতে চাই’। বেশির ভাগ মানুষ এসব ধারধরের বিষয়টা গায়ে লাগায় না। কিন্তু কেউ না কেউ ঠিকই প্রতিবাদ করে। এমন একজন কল করে বসল বিজ্ঞাপনদাতাকে- ‘থাপড়াতে চান কেন? অপরাধ কী!’
যথারীতি কিছুটা দূরে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকার ভান করল কচি। ও-পাশ থেকে কী কথা হলো শোনা গেল না। তবে এ-পাশ থেকে এবার শক্ত ঝাড়ি গেল-‘আকাইম্যা মাস্টার, কারে তুই থাপড়াতে চাস? তারে না থাপড়ায়া বিজ্ঞাপন ঝুলালি কেন? সামনে আয়, তোরে দেখামু থাবড়া কেমনে খায়!’
বাসা, অফিস ও দোকান ভাড়া-সংক্রান্ত টু-লেটও আজকাল প্রচুর ঝোলে। কচির কাজ হচ্ছে হাতে লেখা এসব টু-লেটে থাকা ফোন নম্বর পালটে দেওয়া। ১-কে ২ বানিয়ে দেওয়া যায় সহজেই। আবার শেষে একটা ডিজিট বাড়িয়ে দিলে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে ঘোল খাওয়ানোও যায়। এসব গুজবীয় কাণ্ড বাইরে করতে করতে এবার কচি ঘরেও হাত দিল। আপা ও দুলাভাইয়ের মধ্যে চমৎকার মিল। অথচ কচি ঝগড়া-ঝাড়ি ও ক্যাচাল দেখতে অভ্যস্ত। অসুস্থ বিনোদন ছাড়া তার ভালোই লাগে না। আপা ই বাড়িতে বেড়াতে এসেছে কিছুদিন হলো। দুলাভাই নিজেদের বাড়িতে। এমন পরিস্থিতিতে কচি একদিন হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকে বলল, ‘আপা, তুমি মত দিয়েছ নাকি?’
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, ‘কীসে মত দেব? কোথাও ভোটাভুটি হচ্ছে নাকি!’
‘আরে ওসব না। গঞ্জে আজ দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন বাড়িতে নতুন বউ আনবেন। জনশূন্য বাড়িটা নাকি এতিম হয়ে আছে।’
‘কী বলিস, তোর দুলাভাই এমন মানুষ না!’
‘আমি নিজের কানে শুনেছি।’
কানকথায় জেসমিন প্রথমে মূর্ছা গেল। তেল-পানির ঘঁষায় তার জ্ঞান ফিরলে কল করল স্বামীকে। বলল, ‘শুনলাম, নতুন বউ বাড়িতে আসবে?’
‘আসবে অবশ্যই। কথাবার্তা ফাইনাল। মেয়েটাও খুব সুন্দরী, লক্ষ্মীমন্ত। ভালো বংশ।’
‘আর আমি বুঝি বান্দরি? খারাপ বংশে জন্ম! তোমার কোন অভাবটা অপূর্ণ...।’
কথা শেষ না হতেই ফের মূর্ছা গেল জেসমিন। বাধ্য হয়ে বাবাকে কল দিতে হলো। দুলাভাই অবাক হয়ে বলল, ‘আমার ছোটভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারটা আপনারা সবাই জানেন। নতুন করে কী শুনবেন?’
দেবরের বিয়েকে স্বামীর বিয়ে হিসাবেই রূপ দিয়ে কুচক্রী কচি গুজব ছড়িয়ে দিল। কান মলে দেওয়ার জন্য খুঁজলে কচিকে আশপাশে কোথাও পাওয়া গেলো না। পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝে পগারপার হয়েছে।
বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ ঠিক হলে বাবাসহ জেসমিন শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছাল। বিয়ের অনুষ্ঠান সেরেই ফিরবেন বাবা। এদিকে এলাকার মুরব্বি হিসাবে অনেকেই তাকে খোঁজে। কচি বাজারে যাওয়ার পর এক জেঠার সঙ্গে দেখা হলো। তিনি জানতে চাইলে কচি বলল, ‘আব্বা গ্রামে গেছে। চলে আসবে।’
জেঠা কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও দেখা পেলেন না। বাধ্য হয়ে কচিকে বলতে হলো, ‘আব্বা এই গ্রামে না, চৌদ্দগ্রামে। ওখানে আপার শ্বশুরবাড়িতে। সপ্তাহখানেক থাকেন, পাবেন!’
