স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মহানবীর ডায়েট
নূর আহমাদ
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বর্তমান দুনিয়ায় ডায়াবেটিস, ওবেসিটি, হার্ট, কিডনি, লিভার নষ্টের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিগুলো মারাত্মকভাবে বেড়েই চলেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এ রোগগুলো হয় মূলত ভুল খাদ্যাভ্যাস ও অনিয়ন্ত্রিত জীবন ধারণের কারণে। রাসূল (সা.)-এর খাদ্যাভ্যাস ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক। হুজুরের ডায়েট জীবন কীভাবে একজন মানুষকে সুস্থ জীবন উপহার দেয় এ সম্পর্কে বলেছেন রাজধানীর বারিধারার মাদানী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাফেজ ডা. ইব্রাহিম মাসুম বিল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নূর আহমাদ
- নবীজি (সা.) পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ খালি রাখার যে ফর্মুলা দিয়েছেন, সেটিকে একজন চিকিৎসক হিসাবে ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ প্রতিরোধে কতটা কার্যকর বলে মনে করেন?
মাসুম বিল্লাহ : হাদিসে বলা হয়েছে, পাকস্থলীর এক ভাগ খাবারের জন্য, এক ভাগ পানির জন্য এবং এক ভাগ খালি রাখা উচিত। আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞান একে বলে পরিমিত আহার ও ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণ। আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডায়াবেটিস ও স্থূলতাকে শুধু বেশি খাওয়ার ফল বলা হয় না; বরং এটাকে শরীরের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, খাবার খাওয়ার পর রক্তে শর্করা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া এবং লিভার-চর্বি টিস্যুর ভুল প্রতিক্রিয়ার ফল হিসাবে দেখা হয়। এ বাস্তবতায় নবিজি (সা.)-এর পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ খালি রাখার নির্দেশনা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে আশ্চর্য রকমের মিল রাখে। খাওয়ার সময় যখন পেট কিছুটা ভরে যায় তখন শরীর সময়মতো ‘থামো’ সিগন্যাল দেয়, ক্ষুধা ও তৃপ্তি নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনগুলো ঠিকভাবে কাজ করে এবং খাবার পর রক্তে চিনি ও ইনসুলিন স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। ফলে ডায়াবেটিসের মূল সমস্যা ইনসুলিন কাজ না করা বা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ধীরে ধীরে কমে। একইসঙ্গে লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমা, পেটের ভেতরের ক্ষতিকর চর্বি বৃদ্ধি এবং দীর্ঘদিনের প্রদাহও নিয়ন্ত্রণে থাকে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাকে ‘ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণ’ বা ‘মাইন্ডফুল ইটিং’ বলা হয়, নবীজি (সা.)-এর এ শিক্ষা তারই বাস্তব ও টেকসই রূপ।
-নবীজি (সা.)-এর খাদ্যতালিকায় খেজুর, মধু, যয়তুন বা অলিভ অয়েল, কালিজিরা এবং বার্লি বা তালবিনার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। কার্ডিওভাসকুলার হেলথ বা হৃদরোগ প্রতিরোধে এ খাদ্যাভ্যাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী?
মাসুম বিল্লাহ : আধুনিক কার্ডিওভাসকুলার সায়েন্স বা হৃদরোগবিষয়ক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নবীজি (সা.)-এর খাদ্যতালিকায় থাকা খেজুর, মধু, যয়তুন, কালিজিরা ও বার্লির সমন্বয়টি আসলে ‘ফাংশনাল ফুড’ বা জৈব-সক্রিয় উপাদানে সমৃদ্ধ এমন এক শক্তিশালী ‘সুপারফুড প্যাকেজ’, যা মানবদেহে সিন্থেটিক ওষুধের মতোই থেরাপিউটিক বা রোগ নিরাময়কারী প্রভাব বিস্তার করে। হৃদসুরক্ষার এ বায়োলজিক্যাল মেকানিজমটি বহুমুখী, যেখানে অলিভ অয়েলের ‘পলিফেনল’ ও ‘মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড’ এবং বার্লির ‘বিটা-গ্লুকান’ নামক বিশেষ ফাইবার রক্তনালির ভেতরে ‘এলডিএল’ বা খারাপ কোলেস্টেরলের জারণ প্রতিরোধ করে চর্বির কঠিন আস্তরণ বা ‘অ্যাথেরোস্কলেরোটিক প্লাক’ জমতে বাধা দেয়, যা মূলত হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের প্রধান প্যাথলজিক্যাল কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় খেজুরের উচ্চমাত্রার পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম, যা প্রাকৃতিকভাবে ‘ভ্যাসোডাইলেটর’ হিসাবে কাজ করে রক্তনালিকে প্রসারিত ও নমনীয় রাখে। ফলে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃৎপিণ্ডের পাম্পিং ক্রিয়ার ওপর বাড়তি চাপ বা ‘আফটার-লোড’ কমে যায়। অন্যদিকে, হৃদরোগের নীরব ঘাতক বা ‘সাইলেন্ট কিলার’ হিসাবে পরিচিত দীর্ঘমেয়াদি ধমনির প্রদাহ দমনে কালিজিরার ‘থাইমোকুইনোন’ ও মধুর ফ্লাভোনয়েডগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এজেন্ট হিসাবে কাজ করে, যা রক্তনালির ভেতরের সংবেদনশীল আস্তরণ বা ‘এন্ডোথেলিয়াম’-এর কার্যকারিতা অটুট রাখে এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে মেটাবলিক সিনড্রোম থেকে হার্টকে রক্ষা করে; অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে এ খাদ্যাভ্যাসটি লিপিড প্রোফাইল নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমানোর মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘কার্ডিও-প্রোটেক্টিভ সিস্টেম’ বা হৃদসুরক্ষা কবচ হিসাবে কাজ করে।
-হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এবং খাবারের প্রতিটি লোকমা ধীরে ধীরে তৃপ্তির সঙ্গে খেতেন। আধুনিক বিজ্ঞান এ বিষয়ে কী বলে?
মাসুম বিল্লাহ : হাদিসে বর্ণিত সম্মিলিতভাবে ও ধীরস্থিরে ভোজনের এ রীতিকে আধুনিক নিউরো-সায়েন্স ও পুষ্টিবিজ্ঞান বর্তমানে ‘সোশ্যাল ইটিং’ এবং ‘মাইন্ডফুল ইটিং’-এর একটি অত্যন্ত কার্যকর ‘সাইকো-সোম্যাটিক’ বা মনোদৈহিক নিরাময় প্রক্রিয়া হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বিজ্ঞানের ভাষায়, যখন মানুষ দলবদ্ধভাবে এবং ধীরে ধীরে খাবার গ্রহণ করে, তখন মস্তিষ্কে ‘অক্সিটোসিন’ বা ‘বন্ডিং হরমোন’-এর নিঃসরণ ঘটে এবং স্ট্রেস হরমোন ‘কর্টিসল’-এর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়, যা প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম বা শরীরের ‘রেস্ট অ্যান্ড ডাইজেস্ট’ মোডকে সক্রিয় করে হজমপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে, প্রতিটি লোকমা ধীরে চিবিয়ে খাওয়ার ফলে মুখগহ্বরেই লালাগ্রন্থি নিঃসৃত ‘অ্যামাইলেজ’ ও ‘লিঙ্গুয়াল লাইপেজ’ এনজাইমের মাধ্যমে শর্করা ও চর্বি ভাঙার জটিল জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা ‘সেফালিক ফেজ অব ডাইজেশন’ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় এবং পাকস্থলী থেকে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে ‘লেপটিন’ বা পরিতৃপ্তির সংকেত পৌঁছাতে যে ২০ মিনিট ফিজিওলজিক্যাল সময়ের প্রয়োজন, শরীর সেই সময়টি পেয়ে যায়; এর ফলে ‘ঘেরলিন’ বা ক্ষুধার হরমোন দ্রুত দমিত হয় এবং মানুষ অবচেতনভাবেই অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ বা ‘বিঞ্জ ইটিং’ থেকে বিরত থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে ইনসুলিন স্পাইক নিয়ন্ত্রণ ও ওবেসিটি প্রতিরোধে একটি বিজ্ঞানসিদ্ধ ‘বিহেভিয়রাল থেরাপি’ হিসাবে কাজ করে।
- নবীজি (সা.) মাংস খুব পছন্দ করলেও খেতেন খুব কম পরিমাণে। বর্তমানে রেড মিট এবং প্রসেসড মিটকে ক্যানসারের ঝুঁকির তালিকায় রাখা হয়েছে। নবীজির এ ‘পরিমিত মাংস খাওয়া’ সুস্থ থাকার গাইডলাইন হতে পারে?
মাসুম বিল্লাহ : নবীজি (সা.) মাংস পছন্দ করার পরও তা নিয়মিত বা ভূরিভোজের অংশ না বানিয়ে যে বিরল ও পরিমিত খাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা বর্তমান অনকোলজি বা ক্যানসার বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একটি কালজয়ী ‘প্রিভেন্টিভ প্রোটোকল’ বা রোগ প্রতিরোধের আদর্শ মডেল। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান রেড মিটকে ‘সম্ভাব্য কার্সিনোজেন’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে, কারণ অতিরিক্ত লাল মাংস খেলে অন্ত্রে ‘হিম আয়রন’-এর প্রভাবে এমন কিছু বিষাক্ত যৌগ বা ফ্রি-রেডিক্যাল তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে কোষের ডিএনএ বা জেনেটিক কোড নষ্ট করে কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়। অথচ নবীজি (সা.) মাংসকে প্রাত্যহিক খাবার না বানিয়ে বরং ‘মাঝেমধ্যে’ খাওয়ার যে সংস্কৃতি মেনে চলতেন, তা শরীরকে একদিকে প্রয়োজনীয় হাই-কোয়ালিটি প্রোটিন জোগায় এবং অন্যদিকে মাংসের অতিরিক্ত চর্বি ও প্রোটিন হজম করতে গিয়ে শরীরে যে ‘মেটাবলিক টক্সিসিটি’ বা বিষক্রিয়া তৈরি হয়, তা থেকে শরীরকে রক্ষা করে; যাকে আজকের পুষ্টিবিজ্ঞানীরা ‘ফ্লেক্সিটেরিয়ান ডায়েট’ নামে আখ্যায়িত করছেন এবং সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি বলে মনে করছেন।
-নবীজি (সা.) তরকারির মধ্যে লাউ পছন্দ করতেন। লাউ পেটের স্বাস্থ্য এবং কিডনি ফাংশন ভালো রাখতে কতটা সহায়ক?
মাসুম বিল্লাহ : আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান নবীজি (সা.)-এর প্রিয় সবজি লাউকে একটি চমৎকার ‘হাইড্রেশন হিরো’ এবং প্রাকৃতিক ‘ডিটক্সিফায়ার’ হিসাবে গণ্য করে, যা পাকস্থলী ও কিডনি উভয়ের সুরক্ষায় ওষুধের মতো কাজ করে। বিজ্ঞানের ভাষায়, লাউয়ের প্রায় ৯৬ শতাংশই পানি এবং এতে রয়েছে পর্যাপ্ত দ্রবণীয় ফাইবার ও ক্ষারীয় বা অ্যালকালাইন উপাদান; যা পাকস্থলীর অতিরিক্ত অ্যাসিড প্রশমিত করে বুক জ্বালাপোড়া বা গ্যাস্ট্রাইটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং অন্ত্রের আর্দ্রতা বজায় রেখে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে দারুণ কার্যকর। অন্যদিকে, নেফ্রোলজি বা কিডনি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে লাউ একটি নিরাপদ ‘প্রাকৃতিক ডাইউরেটিক’ বা মূত্রবর্ধক খাবার, যা কিডনির ফিল্টার বা ছাঁকনিগুলোর ওপর কোনো বাড়তি চাপ না দিয়েই প্রস্রাবের প্রবাহ বাড়িয়ে শরীর থেকে সোডিয়াম, ইউরিক অ্যাসিড ও অন্যান্য বিষাক্ত বর্জ্য ধুয়ে বের করে দিতে সাহায্য করে; সহজ কথায়, লাউ অত্যন্ত সহজপাচ্য হওয়ায় এটি আমাদের বিপাকতন্ত্রকে বিশ্রাম দেয় এবং শরীরকে ভেতর থেকে ঠান্ডা রেখে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা মূত্রনালির সংক্রমণ ও কিডনি পাথর প্রতিরোধে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।
