ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দুনিয়ার অধিকাংশ রাজনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের চিন্তা, প্রয়োজন ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গঠিত। তাই এগুলো সীমাবদ্ধ, পরিবর্তনশীল এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত। গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামরিক শাসন সব ব্যবস্থাই কোনো না কোনোভাবে মানুষের ইচ্ছা, শক্তি বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর দাঁড়ানো; ফলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দলাদলি, ভোটের বাজার এবং প্রভাবশালী শ্রেণির কর্তৃত্ব এড়ানো যায় না।
কিন্তু ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা এসব ব্যবস্থার মতো মানুষের রচিত নয়; বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এক দিব্য ও ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি, যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র এ তিন স্তরের ন্যায় ও কল্যাণ নিশ্চিত করে। ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলভিত্তি হলো : সার্বভৌমত্ব আল্লাহর, আইন কুরআন ও সুন্নাহ, শাসক নীতির রক্ষক, জনগণের প্রভু নয়, পরামর্শ, ন্যায় ও জবাবদিহিতা বাধ্যতামূলক, জনগণের অধিকার সুরক্ষিত, দলাদলি ও ক্ষমতা দখলের লালসা থেকে মুক্ত এক শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা-হস্তান্তর ব্যবস্থা।
গণতন্ত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হলো জনগণের ভোট। সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে একটি দল বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দখল করে এবং বিরোধী দলকে প্রতিপক্ষ নয় বরং শত্রু মনে করে। দল ও দলনেতার প্রতি আনুগত্য, নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি, ক্ষমতার লড়াই, টাকাকেন্দ্রিক প্রচারণা এসব গণতন্ত্রের স্বভাবসিদ্ধ সমস্যা। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়, গণতন্ত্রে নৈতিকতা নয়, সংখ্যা এটাই আইন নির্ধারণ করে।
অন্যদিকে রাজতন্ত্রে একজন ব্যক্তি বা পরিবার রাষ্ট্রের মালিক হয়ে ওঠে। জনকল্যাণ তার সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদে রাষ্ট্র একটি কঠোর আদর্শিক বন্দিত্বে পরিণত হয়, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। এ তিন ব্যবস্থার কোথাও ইমান, নৈতিকতা, আল্লাহভীতি বা আখিরাতের জবাবদিহিতাকে কেন্দ্রীয় শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি।
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক স্বরূপ
ইসলামে ক্ষমতার অধিকার জনগণের নয়, শাসকেরও নয়-এ অধিকার শুধু আল্লাহর। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে শাসক একজন খলিফা বা আমির হন, যিনি আল্লাহর আইন প্রয়োগ ও জনগণের অধিকার রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত। তিনি জনগণের প্রতিনিধি হয়ে আইন তৈরি করেন না; বরং কুরআন-সুন্নাহর আইন বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল।
ইসলামে নেতৃত্ব কোনো প্রতিযোগিতা নয়; বরং এটি ভারী আমানত। নবী (সা.) বলেছেন, ‘নেতৃত্ব চাওয়া ব্যক্তি নেতৃত্বের যোগ্য নয়।’ তাই ইসলামে ক্ষমতা দখল বা নির্বাচনি প্রচারণা অনুমোদিত নয়।
ক্ষমতা নির্বাচন ও হস্তান্তরের পদ্ধতি
ইসলামে শাসক নির্বাচনের দায়িত্ব জনগণের নয়; বরং আহলুল হাল ওয়াল আকদ নামে একটি জ্ঞানী, সৎ, বিচক্ষণ ও স্বীকৃত ব্যক্তিবর্গের পরিষদের। তারা পরিস্থিতি বিবেচনায় সর্বোত্তম যোগ্য ব্যক্তিকে খলিফা হিসাবে মনোনীত করেন। জনগণ এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়, কারণ পরিষদ জনগণের সম্মতিতে গঠিত এবং তাদের যোগ্যতা সর্বজনবিদিত। এ ব্যবস্থায় ব্যয়বহুল নির্বাচন, দলাদলি, টাকা-পয়সা, প্রচারণা, ক্ষমতা দখলের ভয় কিংবা বিশৃঙ্খলার কোনো সুযোগ নেই।
এখানে একটি সাধারণ প্রশ্ন ওঠে ‘বিরোধী দল না থাকলে শাসক কি স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে?’ ইসলামের উত্তর না, কারণ তিনটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা রয়েছে-
আহলুল হাল ওয়াল আকদ-স্বাধীন তদারকি পরিষদ : শাসক তাদের অধীনস্থ নন; বরং তারাও শাসককে প্রশ্ন করতে ও বিচারের আওতায় আনতে পারেন। প্রয়োজন হলে খলিফাকে অপসারণ পর্যন্ত করতে পারেন। তারা হলো ইসলামের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ ব্যবস্থা, তবে দলীয় রাজনীতির সংঘাত ছাড়াই।
শরিয়তের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব : খলিফা কোনো সিদ্ধান্ত শরিয়তবিরোধী দিতে পারেন না। তিনি যদি নিজের ইচ্ছায় আইন করতে চান, তা সঙ্গে সঙ্গে বাতিল। শরিয়তের ওপরে কারও ক্ষমতা নেই এটাই ইসলামি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।
জনগণের সরাসরি প্রশ্ন করার অধিকার : ইতিহাস সাক্ষী এক সাধারণ মানুষও খলিফা উমর (রা.)-কে প্রশ্ন করেছেন তার পোশাকের কাপড় কোথা থেকে এসেছে। শাসককে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। অর্থাৎ জনগণ নিষ্ক্রিয় দর্শক নয়; বরং জবাবদিহিতার সক্রিয় শক্তি।
ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা কেন শ্রেষ্ঠ?
এখানে নীতি পরিবর্তন হয় না আইন আল্লাহর। ক্ষমতা ব্যক্তি বা দলের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় না। জনগণের অধিকার পূর্ণরূপে সুরক্ষিত। দলাদলি, ক্ষমতার লড়াই, ধ্বংসাত্মক রাজনীতি নেই। নেতৃত্ব নৈতিকতা, জ্ঞান, ইমান ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন হয়। জবাবদিহিতা শুধু জনগণের কাছে নয়, আল্লাহর কাছেও। সমাজে ন্যায়, সমতা, নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা শুধু একটি রাজনৈতিক মডেল নয় এটি আল্লাহ প্রদত্ত ন্যায়ভিত্তিক সভ্যতা। মানুষের রচিত ব্যবস্থার মতো এটি সংকট, স্বার্থ ও সংঘাতের ওপর দাঁড়িয়ে নয়। বরং এটি স্থাপিত-সত্য ও ন্যায়ের আদর্শে, দিব্য আইনের নির্দেশনায়, পরামর্শ, জবাবদিহিতা ও আল্লাহভীতির ভারসাম্যে, নাগরিকদের রক্ষা ও কল্যাণের উদ্দেশ্যে।
আজকের বিশ্ব যখন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, দলাদলি, নৈতিক সংকট ও ক্ষমতার অপব্যবহারে জর্জরিত, ইসলামের দিকনির্দেশনাই মানবতার সামনে একমাত্র টেকসই ও ন্যায়পরায়ণ পথ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে।
