কী পড়ছেন কওমি মাদ্রাসার মেয়েরা
হাফেজ শাহ শরীফ
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: বিবিসি বাংলা
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাড়ছে কওমি মহিলা মাদ্রাসার সংখ্যা। ১৮৬৬ সালে ভারতের প্রথম কওমি মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। মহিলা মাদ্রাসা তারই একটি অংশ। কওমিওয়ালারা সহশিক্ষার বিরোধিতা করে মহিলা মাদ্রাসা ব্যবস্থা চালু করেন। মেয়েদের হাফেজা, আলেমা বানান হয় এসব প্রতিষ্ঠানে।
মহিলা মাদ্রাসার সিলেবাস কারিকুলাম কওমি মাদ্রাসার অনুকরণেই তৈরি নব্বইয়ের দশকে দেশে মহিলা মাদ্রাসা ব্যবস্থা চালু হয়। এ দেশের প্রথম মহিলা মাদ্রাসা কোনটি নির্দিষ্ট জানা নেই। অনেক আলেমের মতে রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদ্রাসা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এর সংখ্যা বেড়েছে।
একটা সময় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কওমি মাদ্রাসায় এতিম গরিব ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করবে। এসব মাদ্রাসার সিলেবাস ছিল এক রকম। শুধু আরবি উর্দু ফার্সি পড়ানো হতো। ইংরেজি পড়া ছিল হারাম। বর্তমানে তাদের চিন্তাচেতনা পরিবর্তন হয়েছে। যুগোপযোগী সিলেবাস তৈরি হয়েছে। কওমি মাদ্রাসার প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দে ইংরেজির প্রতি অনেক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দুটি মহিলা মাদ্রাসা ঘুরে এর হালচাল তুলে ধরছি।
রাজধানীর কুড়িলে রয়েছে মা’হাদু তালীমিল বানাত মহিলা মাদ্রাসা। ছাত্রী সংখ্যা ২৪০। মাদ্রাসার নাযেমে তালিমাত (শিক্ষা সচিব) মাওলানা মোহাম্মদ মহিউদ্দীনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম মহিলা মাদ্রাসার সিলেবাস ও পাঠদান সম্পর্কে।
তিনি বলেন আমাদের মাদ্রাসার সিলেবাস যুগোপযোগী। কওমি শিক্ষা বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে ফার্সি উর্দু বাদ দিয়ে আরবি বাংলা ইংরেজির গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এক সময় কওমি মাদ্রাসায় ইংরেজি অঙ্ক পড়ান হতো না। এখন এসবই গুরুত্ব দিয়ে পড়ান হয়। আমাদের পুরো মাদ্রাসা মহিলা শিক্ষিকারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। পুরুষ শিক্ষকরা পর্দার আড়াল থেকে ক্লাস করান।
জানতে চেয়েছিলাম ইসলাম নারী শিক্ষার ব্যাপারে কী বলেছে? মাওলানা মহিউদ্দীন বেনাপোল নেপোলিয়নের বিখ্যাত উক্তি শুনিয়ে বলেন- ‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব’। ইসলাম কখনও নারী শিক্ষার বিরোধিতা করেনি। নবী করিম (সা.) সর্বপ্রথম ইসলামের দাওয়াত নিজ ঘরে তার স্ত্রী খাদিজাকে (রা.) দিয়েছিলেন। হজরত আয়েশা (রা.) রাসূল থেকে ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেন।
ইসলাম নারীদের সুষ্ঠু নিরাপদ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে বলেছে। ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু কিছু মহিলা মাদ্রাসার ছাত্রীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এটি বন্ধ করতে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের আরও সতর্ক হতে হবে।
আল খিদমাহ নিযামিয়া মহিলা মাদ্রাসা রাজধানীর ছোলমাইদে রয়েছে। ছাত্রী সংখ্যা ১৫০। কথা বলছিলাম মাদ্রাসার মোহতামিম মাওলানা হাবীবুর রহমান সালিমের সঙ্গে।
মাদ্রাসার খরচ কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাদ্রাসা মানেই এতিমখানা নয়। মাদ্রাসা মানেই রাস্তাঘাটে ঘুরে চাঁদা কালেকশন নয়। কওমি মাদ্রাসা জনগণের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত হয়। আর্থিক অনুদানের একটি ফান্ড থাকবে। গরিব ছাত্রছাত্রীদের জন্য তার থেকে খরচ করা হবে। সামর্থ্যবান ছাত্রছাত্রী নিজ টাকায় পড়ালেখা করবে। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য আজকাল অনেক মাদ্রাসা রাস্তাঘাট, বাজারে চাঁদা কালেকশন করছে। এতে মাদ্রাসার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি খারাপ হচ্ছে।
ছাত্রীদের কর্মক্ষেত্র কী হবে জানতে চাইলে মাওলানা হাবীবুর রহমান বলেন। মহিলা মাদ্রাসার ছাত্রীদের কর্মক্ষেত্র কম। তাদের কর্ম শুধু মহিলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করা। দেশে মাদ্রাসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কর্মক্ষেত্রও বাড়ছে।
মহিলা মাদ্রাসার প্রতি মানুষের আগ্রহ কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মহিলা মাদ্রাসায় ছাত্রীর সংখ্যা। এক সময় মহিলারা ছিল ঘরমুখী। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। স্কুল-কলেজের পাশাপাশি মহিলা মাদ্রাসার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।
কথা বলছিলাম মোছাম্মদ সুমাইয়া আলীর সঙ্গে। আল খিদমাহ নিযামিয়া মহিলা মাদ্রাসায় নাহুমির জামাতে পড়ছে সে। মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সুমাইয়া বলেন, মহিলা মাদ্রাসা ব্যবস্থা আমার পছন্দ। এখানে মেয়েরা আলাদা পড়ালেখার সুযোগ পায়। আমরা পুরোপুরি পর্দা মেনেই ইল্ম শিখতে পারছি। এখানে জেনারেল শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি বিষয়ে কওমি মেয়েদের মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি সরকারের একটি মহৎ কাজ। সরকার শুধু দাওরা হাদিসকে মাস্টার্স সমমান দিয়েছে। নিচের ক্লাসগুলোর কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই। কেউ যদি দাওরা হাদিস শেষ করতে না পারে তার কোনো সরকারি স্বীকৃতি থাকবে না। জেনারেল বোর্ডের সঙ্গে মিল করে কওমি বোর্ডের নিচের ক্লাসগুলো সরকারি সনদের সমমান দিলে কওমি ছাত্রছাত্রীরা অনেক উপকৃত হবেন।
মাদ্রাসার ভেতরের পরিবেশ কেমন জানতে চাইলে সুমাইয়া বলেন। আমরা সব সময় মাদ্রাসার ভেতরে থাকি। প্রয়োজনীয় কাজ নিজেরাই করি। নিজের ঘরের মতো মাদ্রাসা গুছিয়ে রাখি। প্রয়োজনীয় যে কোনো বিষয় মহিলা শিক্ষিকাদের সঙ্গে শেয়ার করে সমাধান করি।
পরিবর্তনশীল সামাজিক চাহিদা পূরণে মহিলা মাদ্রাসা শিক্ষাকে আরও যুগোপযোগী করে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বেশি উপকৃত হবেন।
ই-মেইল : mdshahsharif82@gmail.com
