এবারের সংগ্রাম ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম
আহমাদ উল্লাহ
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জনগণের সঙ্গে কোলাকুলি করছেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এক সফেদ পুরুষ। লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবির ওপর কালো কোট। টানটান করে পেছনে আঁচড়ানো দু’কান ছোঁয়া চুল। সুঠাম উঁচু দেহের এ পুরুষটি যখন তর্জনী তুলে কিছু বলতে শুরু করতেন, জেগে উঠত জনতা।
নেচে উঠত তাদের হাত-পা, ধমনির রক্ত। পল্টন ময়দানে স্লোগানে স্লোগানে জানান দিত- ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
ময়দান ভরা জনতার মিছিল পল্টন থেকে শাহবাগ। শাহবাগ থেকে মধুর ক্যান্টিন কখনও বা শহীদ মিনারে এসে সমাপ্তি টানত। এসব মিছিলে কে-না আসত? ছাত্র-যুবদের পাশাপাশি ছুটে আসত সুশীল সমাজ। আসত কৃষক, শ্রমিক, কামার-কুমার, কুলি-মজুর, মেথর, জেলেসহ সব ধরনের খেটে খাওয়া মানুষ। সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি হাতে হাত, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছিল- ‘ওরা আমার মায়ের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’
২৪ বছর জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করে লড়াই সংগ্রাম শেষে সফেদ সেই পুরুষটি একদিন তর্জনী উদ্যত করলেন রেসকোর্স ময়দানে। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ দীর্ঘ সাধনায় সাধারণ মানুষ যেমন সাধক হয়ে ওঠে, তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানও মানবসাধক বনে গেলেন। মুজিব যখন সাধক হন রহমান তখন কবুল করে নেন তার সব আরজি। কেননা মুজিব মানে কবুলকৃত। রহমান মানে আল্লাহ। সফেদ পুরুষটির নামের অর্থ দাঁড়াচ্ছে- মুজিবুর রহমান মানে আল্লাহর কবুলকৃত বান্দা। শেখ হচ্ছে তার বংশধারা।
কবুলকৃত নামের সেই সফেদ ইমাম অর্থাৎ নেতার জন্ম ১৭ মার্চ আর একই মাসের ২৬ মার্চে তিনি ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতার। ইমাম যেহেতু ডেকেছেন তাই মাবুদ আমজনতাকে জুটিয়ে দিয়েছেন কাতারবন্দি করে। জয় হয়েছে জনতার।
লাল-সবুজের নিশান উড়েছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে। চির স্বাধীন মানুষ পেয়েছে ভৌগোলিক স্বাধীনতা। বাঙালির ইমাম তো মানবমুক্তির সংগ্রামও চেয়েছিলেন। যে কারণে কামার-কুমার, তাঁতি, জেলে-মজুর দাঁড়িয়েছিল তার ইমামতিতে এক ময়দানে।
আফসোস! মানুষ শুধু ভৌগোলিক সংগ্রামে জিতে ভুলে গেছে মুক্তির সংগ্রামের কথা। আমজনতার ইমাম তো দেশ জনতার মুক্তিও চেয়েছিলেন। ভৌগোলিক সংগ্রাম ক্ষণস্থায়ী। মানবমুক্তির সংগ্রাম চিরস্থায়ী। মহান মাবুদ চেয়েছেন তার সৃষ্ট মানুষ যেন চিরস্থায়ী সংগ্রামে জিতে গিয়ে দুনিয়াতেই বেহেস্তি আনন্দের স্বাদ বুঝতে পারে। সৃষ্টির শুরু থেকেই এক মানবকে বঞ্চিত করে আরেক মানব লাভবান হয়েছে। পূর্ণ করেছে কামনা-বাসনার স্বাদ।
আপন ভাই ভাইকে হত্যা করে ছিনিয়ে নিয়েছে সুন্দরী রমণী। হাবিল-কাবিল দুই ভাই হত্যা, দখলের প্রথম উদাহরণ দুনিয়ার। হত্যা, দখল, অত্যাচারে দুনিয়া ছেয়ে গিয়ে মানবতা যখন মুখ থুবড়ে পড়ত, মাবুদ তখনই ইমাম পাঠাতেন দুনিয়ায়। যাদের আমরা নবী-রাসূল বলে মানি। তাদের প্রধান কাজ হতো দুনিয়ার মানুষের জন্য মানবতার মুক্তির সংগ্রাম জারি করা। মুক্তির এ সংগ্রামে নেমে যুগে যুগে কত ইমাম যে শহীদ হয়েছেন মাবুদের বাণী কোরআন সেই কথা কিয়ামত পর্যন্ত জনে জনে পৌঁছে দেবে।
অতএব, বাঙালির সফেদ ইমামের আত্মা এসব জানত বলেই হয়তো তার জন্ম নামটি হয়েছিল মুজিবুর রহমান- অর্থাৎ আল্লাহ যার ডাক কবুল করেছেন। হ্যাঁ, তার শাহাদত আঙুলের কাকুতি কবুল হয়েছে বলেই মাবুদ আমাদের স্বাধীনতা শব্দটি দান করেছেন। স্বাধীনতা পেলে দেশ-জনতাকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তাকে হতে হয় বিনয়ী। কেননা স্বাধীনতা যে কেউ খুঁজে পায় না। স্বাধীনতা পেতে ভাগ্যে জুটতে হয় একজন যোগ্য ইমামের।
ইমামগণ যে কোনো গোত্রে, দেশে নিজে নিজেই জন্ম নেন না। মাবুদ যে গোত্রে, যে দেশে চান সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন তারা। এক ইমাম তখন সব গোত্রকে একত্রে এনে মুক্তি-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে মানবের মুক্তি ঘটান। এই হচ্ছে ইমামের ইমামতির ধারা। আমাদের সফেদ সুঠামদেহী লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি পরা ইমাম, তেমনই সব দল-উপদল ভেঙে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডার মানুষকে এক ময়দানে এনে জড়ো করেছিলেন।
জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ নামে একটি উর্বর বাগান। হায় আফসোস! তারা বাগান পেয়েই খুশিতে আটখানা হয়ে ফুল না ফুটতেই ইমাম ভ্রমরকে শহীদ করে ফেলল। ভ্রমর গান না ধরলে দেশময় মানব বাগানে কী করে ফুটবে ফুল? এ দেশে আজ বাগানভরা গাছ অর্থাৎ মানুষ আছে, কিন্তু ফুল নেই। তাই বাংলাদেশ খুশবু ছড়ায় না। এ দেশে আমরা আজ খুশবুহীন ফুল মানুষে পরিণত হয়েছি।
যারা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের কর্তৃত্ব করে নেতৃত্ব দেয়, তারা যেদিন থেকে মানব মুক্তির সংগ্রাম জারি করবে, সেদিন থেকেই নতুন সফেদ পাঞ্জাবি পরা ইমামের রুহানি প্রভাব পেতে থাকবে দেশ। মাবুদ খুশি হয়ে তখন হয়তো আবার কোনো কবুলকৃত বান্দাকে ইমাম নিয়োগ দেবেন আমাদের জন্য। ইমামহারা জাতি ধন্য হব আমরা আবার নতুন ইমাম পেয়ে।
মাবুদ যে ইনসান সৃষ্টি করেছেন, তারও আগে তিনি ইনসাফময় সবুজ পৃথিবী বানিয়ে রেখেছেন। সবুজ জমিন বিছিয়ে তিনি কোথাও কোথাও মিঠা জলের নদী প্রবাহিত করেছেন। বৃক্ষ, লতাপাতায় বাগান সাজিয়ে ফুল-ফলের সমাহার ঘটিয়েছেন। অসংখ্য তারায় ভরা নীল আসমান গড়ে চাঁদ-সুরুজের পিদিম জ্বালিয়েছেন। মাবুদের এসব সৃষ্টি তারই হুকুমে, তার প্রেমময় মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ইনসাফ বিলি করে বেড়াচ্ছে। সূর্যের আলো সব মানুষ সমানভাবে ভোগ করছে। চাঁদের আলোও তেমনি। পৃথিবীর যা কিছু মানুষের যেভাবে ভোগ করা প্রয়োজন, সেভাবেই সবার প্রয়োজন মেটানোর কথা।
কিন্তু এক মানুষ যখন অন্য মানুষের ক্ষণস্থায়ী ইনসাফ কেড়ে নিল, তখনই বিপত্তি ঘটল পৃথিবীতে। মানুষের বিপত্তি দূর করে ইনসাফ ফেরাতে ইনসানের জন্য মাবুদ পাঠাতে লাগলেন মূসা, ঈসা, মুহম্মদের মতো নবী-রাসূল এবং খলিফা ইমামতের। তাদের নেতৃত্বে ইনসানের জন্য ইনসাফ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দুনিয়ায়। এভাবেই মহান মাবুদ চান দুনিয়ায় শান্তি বিরাজ করাতে। তাই তিনি তার বাণী কোরআনুল কারিমে ইনসানের জন্য বর্ণনা করেন আপন রাজ্য পরিচালনার বিষয়টি।
লিল্লাহি মুলকুস সামাওয়াতি
ওয়াল আরদি ওয়ামা ফিহিন্না
ওয়াহুয়া আলা কুল্লি
শাইয়িন কাদির।
(সূরা : মায়েদা, আয়াত : ১২০)
ভাব-তরজমা : ‘আকাশসমূহ, পৃথিবী এবং এদের অধীনে যা কিছু রয়েছে এ সবের ওপর আল্লাহর রাজত্ব (ন্যায়, ইনসাফ, প্রেমনীতির ধারা বিরাজমান) প্রতিষ্ঠিত। মহান আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’
মানুষ চর্মচোখে এক আকাশ দেখছে জন্ম থেকে। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন আকাশসমূহ। সূফি দরবেশরা বলেছেন সপ্ত আসমান, সপ্ত জমিন সৃজন করেছেন আল্লাহ। এ আয়াতেও মাবুদ বহু আকাশ এবং জমিনের ইঙ্গিত রেখেছেন। এ সবের ওপর আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত বলে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছেন। তার এসব রাজ্যের একটি হচ্ছে মানব বাসযোগ্য দুনিয়া। অতএব, এ পৃথিবী নামক রাজ্যে তিনি তার প্রতিনিধি সৃষ্টি করেন কাউকে খলিফা, কাউকে ইমাম বানিয়ে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে মানবতার মুক্তি ঘটিয়ে ইনসানের দুনিয়ায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। লম্বা ঝুলের সফেদ পাঞ্জাবি পরা সুঠামদেহী তর্জনী নাচানো আমাদের ইমাম যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম উচ্চারণ রেখে গেছেন এ উচ্চারণই মানব মুক্তির ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এ সংগ্রামে শরিক হলে মানুষ দুনিয়াতেই মাবুদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার ইনসাফি রাজ্যে প্রবেশ করবে।
ইউ রিদুল্লাহু/আই উ খাফফিফা/আনকুম/ওয়া খুলিকাল/ইনসানু দয়িফা
(সূরা : নিসা, আয়াত : ২৮)
ভাব-তরজমা : ‘মানুষকে বড় দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে। মাবুদ তার বোঝা নানা উপায়ে হালকা করতে চান কখনও ফলিফার মর্যাদা দিয়ে, কখনও ইমামের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে।’
তার অপার লীলা কে বোঝে? মানব কিতাব পড় খুঁজে।
লেখক : সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক
