নিজেকে বদলে নেয়ার মাস রমজান
তানজিল আমির
প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে এসেছে সাধনা ও আত্মশুদ্ধির মাস রমজান। এ মাস কুরআন নাজিলের মাস। কাম, ক্রোধ, মোহ ও রিপু দমন করার মাস। আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য ও খোদাভীতি অর্জনের মাস।
সর্বোপরি মহান রাব্বুল আলামিনের ক্ষমা ও নৈকট্য অর্জনের মাস। মহান আল্লাহতায়ালার বাণী, হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর; যাতে তোমরা খোদাভীতি অর্জন করতে পার (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে এবং সওয়াব অর্জনের আশায় সিয়াম আদায় করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে (বুখারি, মুসলিম)।
দয়াময় আল্লাহ পবিত্র মাহে রমজানে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাজিল করে এ মাসকে সব মাসের ওপর মর্যাদাবান করেছেন।
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে; যা মানুষের হিদায়াত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৫)।
সিয়াম বলতে শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা বোঝায় না বরং অন্যায়-অসত্য, পরনিন্দা-অশ্লীলতা ইত্যাদি পাপাচার থেকে আত্মাকে কলুষমুক্ত করা বোঝায়। সিয়ামের পুণ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য পানাহার বর্জনের সঙ্গে পাপাচার-অশ্লীলতা বর্জন না করলে সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য সাধনই ব্যর্থ।
এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকতে না পারে তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো প্রয়োজন নেই’ (বুখারি)।
সিয়াম শুধু আল্লাহর উদ্দেশে এবং গোপন ইবাদত হওয়ার কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সিয়ামের জন্য বিশেষ প্রতিদানের ঘোষণা দিয়েছেন।
হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, ‘আল্লাহ বলেন, আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার জন্য কিন্তু সিয়াম ব্যতিক্রম। কেননা সিয়াম আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দেব’ (বুখারি ও মুসলিম)।
রমজানের তাৎপর্য দিনের উপবাস আর রাতের তারাবিতেই শেষ নয়। মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা (নিজের মাস) এ ক্ষেত্রে আরও অধিক তাৎপর্যময়।
যেসব বান্দা ১১ মাস পার্থিব ব্যস্ততায় গাফিলতের নিদ্রায় বিভোর থাকে এবং আল্লাহ থেকে দূরে থাকে- এই এক মাসে আল্লাহ তাদেরকে নৈকট্য দান করেন। তাদের ডেকে বলেন, বান্দা, তোমরা আমার নৈকট্য থেকে বহু দূরে পড়ে ছিলে, দুনিয়ার ধ্যান-খেয়াল নিয়ে ব্যস্ত ছিলে।
তোমাদের চিন্তা-চেতনা, তোমাদের কাজকর্ম, তোমাদের দৌড়ঝাঁপ, সব দুনিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। এখন আমি তোমাদের একটি মাস দান করছি, এ মাসে তোমরা আমার কাছে এসে পড় এবং সিয়ামময় জীবনযাপন কর। আমি তোমাদেরকে নৈকট্য দান করব। কেননা, এটি আমার নৈকট্য অর্জনের মাস।
রোজার মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করেন। রিপুর তাড়না থেকে তাকে মুক্ত করে তার ভেতর তাকওয়া খোদাভীতি ও আল্লাহপ্রেম জাগ্রত করে দেন। তাকে সেই সত্য-সুন্দরের পথে পরিচালিত করতে চান, যে সত্য-সুন্দরের পথ তাকে নিয়ে যাবে সফলতা ও মুক্তির দরজায়।
তার ভেতর সৃষ্টি করে দেবেন প্রেম, আর এ প্রেমই তাকে নিয়ে যাবে পূর্ণ আনুগত্য ও সন্তুষ্টির পথে, সে ক্রমেই পাগলপারা হয়ে উঠবে তার প্রেমিক আল্লাহকে পাওয়ার জন্য। তখন প্রতিটি সৎ কাজ ও আল্লাহর বিধানে সে খুঁজে পাবে প্রশান্তি। অসৎ ও যে কোনো পাপ তাকে পীড়া দেবে।
আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সে হবে দরদি। তার ভেতর জাগ্রত হবে মনুষ্যত্ব, মায়া-মমতা, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যরে মতো মানবিক গুণাবলী। এর ফলে তার মনে থাকবে না হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অরাজকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ।
খতম হবে তার অহমিকা ও আমিত্ববোধ (যা হাজারও অন্যায় ও অনাচারের জন্মদাতা) সৃষ্টি হবে হৃদয়জুড়ে ভালোবাসা। এ উদ্দেশ্যে ও শিক্ষা নিয়েই প্রতি বছর মাহে রমজান মুসলিম উম্মাহর দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। এবারও এসেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে শিক্ষা ও উদ্দেশ্য নিয়ে রমজান আমাদের মাঝে এসেছে সে শিক্ষা আমরা অর্জন করতে পারি কিনা? সত্যিকার অর্থে বাস্তবতার প্রতি লক্ষ করলে দেখা যায়, রমজানের শিক্ষা থেকে আমরা বঞ্চিত, যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ আমাদের জন্য রমজানের বিধান দিয়েছেন তা আমরা অর্জন করতে পারছি না, রমজান আমাদের জীবনে তেমন কোনোই পরিবর্তন আনছে না।
রমজান এলে ইবাদত-বন্দেগিতে ঠিকই হয়তো মনোযোগী হচ্ছি কিন্তু রমজান চলে গেলে সেই আগের মতোই তা ছেড়ে দিচ্ছি। রমজানের আগে যেমন ঘুষ, দুর্নীতি, পণ্যে ভেজাল করা, কালোবাজারি, মজুদদারি, মাপে কম দেওয়া, ধোঁকাবাজি, ছলচাতুরি, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি অমানবিক কর্মে ছিলাম রমজানের পরে ঠিক আগের মতোই এসব করে যাচ্ছি।
তাহলে রমজান আমার জীবনে কি পরিবর্তন আনল? রমজান থেকে আমি কী শিক্ষা অর্জন করলাম? নিশ্চয় কোথাও আমাদের ত্রুটি রয়েছে। আর সে ত্রুটি হলো, আমরা কেবল না খেয়ে থাকা বা উপবাসব্রতকে রোজা বা সিয়াম সাধনা মনে করছি, অথচ পানাহার ও কামবৃত্তি থেকে বিরত থাকা রোজার একটি অংশবিশেষ, এটুকুর নাম রোজা নয়।
হাত-পা, কর্ণ-নাসিকা, চোখ-মুখ, মেধা-মনন, অন্তর-আত্মা, চিন্তা-গবেষণা অর্থাৎ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রয়েছে রোজা। সেগুলোর প্রতি আমরা একটুও খেয়াল করছি না, ফলে রোজা আমাদের জীবনে তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না।
হে রোজাদার! আসুন! রোজার প্রকৃত শিক্ষা ও উদ্দেশ্যের প্রতি যত্নবান হয়ে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করি, মানবিক গুণাবলিতে জীবনকে করি আলোকিত।
এটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে পরস্পরে গড়ে উঠবে মধুর সম্পর্ক, সমাজ থেকে বিদায় নেবে অরাজকতা, অন্যায়-অনাচার। এভাবে দুর্নীতি ও ভেজালমুক্ত হয়ে আদর্শ জাতি হিসাবে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। খুঁজে পাব সফলতা।
তা না হলে রমজান আসবে, রমজান যাবে, আমরা কিছুই পাব না। আল্লাহতায়ালা আমাদের এ বিষয়গুলো উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন।
লেখক: তরুণ আলেম ও ধর্মীয় গবেষক
