|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, (হে নবি) আমি তোমাকে সারা জগতের জন্য রহমত বানিয়ে পাঠিয়েছি। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)।
সব নবি-রাসূলই মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য আহ্বানকারী হয়ে এসেছিলেন, হজরত মুহাম্মদও (সা.) তা-ই, কিন্তু আল্লাহ পাক তাকে বিশেষভাবে কেন ‘রহমত’ বললেন তা জানার জন্য আমাদের একটু নজর বোলাতে হবে তৎকালীন পৃথিবীর ইতিহাসে।
প্রথমত আমাদের জ্ঞানে থাকতে হবে হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কার্যপরিধি কেবল এতটুকুই ছিল না যে, তিনি জনে জনে শুধু কুরআনের বাণী মানুষকে পড়ে শোনাবেন। বরং তিনি সেই বাণী তার জীবনে কার্যত বাস্তবায়ন করেও দেখিয়েছিলেন, যাতে করে মানুষ একজন চাক্ষুষ রোল মডেল পায়।
কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের জীবন দুটি, পার্থিব জীবন ও পরকালীন জীবন। কিন্তু আমল করার ক্ষেত্র একটাই তা হলো ইহজীবন। পরকালে আমরা কোন অবস্থানে থাকব তার পুরোটাই নির্ভর ইহজীবনের ওপর। তাই পরকালীন জীবনে মুক্তি লাভের জন্য আমাদের সামনে মাত্র দুটি পথ আল্লাহর হক আদায় ও বান্দার হক রক্ষা করা। আল্লাহর হকের ক্ষেত্র হলো কেবল ইবাদত, যেসবের সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে। অন্যদিকে বান্দার হক হলো পরস্পরের মাঝে আর্থসামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা।
শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (র.)-এর মতে, আল্লাহর হক তখনই রক্ষা করা সম্ভব, যখন বান্দার হক রক্ষা হবে। কেননা বেশিরভাগ সময় আর্থসামাজিক বৈষম্য আল্লাহর হক আদায়ের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। বান্দাকে তার প্রভুর শরণাপন্ন হতে দেয় না। আর আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য তখন থেকে শুরু হয়, যখন কিষান-মজদুরের রক্ত-ঘামে উৎপাদিত শস্যের খাজনায় রাজা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ধনিক শ্রেণি ভোগবিলাসী জীবনযাপনে মশগুল হয়।
রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করার বদলে শাসকশ্রেণি যখন বসে বসে খেতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে প্রদর্শনীমূলক অহঙ্কার জন্ম নেয়। কার চেয়ে কে বেশি ফ্যাশনদুরস্ত, কার মুকুট বেশি রত্নখচিত, কার দালান আকাশচুম্বী ও দামি পাথরে নির্মিত, এ ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এহেন ঠাটঠমক সমাজের গতিপথ বিচ্যুতির দিকে নিয়ে যায়। নিত্যনতুন ফ্যাশন, রাজকীয় শানশওকত বজায় রাখতে ক্ষমতাসীন লোকেরা অধীনস্থদের সহায়-সম্পত্তিতে হাত বাড়াতে থাকে।
ট্যাক্স কালেক্টররা কৃষকদের চাপ দিতে থাকে, খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ইহকালীন ও পরকালীন মঙ্গল তো দূর কি বাত, খোদার দরগাহে তখন কৃষকদের মেঘ আর পানি ছাড়া কিচ্ছু চাওয়ার থাকে না। এভাবেই দিনের পর দিন চলতে থাকে বান্দার হক নষ্টের মচ্ছব।
এ কারণেই শাহ সাহেব মনে করতেন, বান্দার হক রক্ষার মধ্য দিয়ে আল্লাহর হক রক্ষার ক্ষেত্র তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘এমন একটি রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করা যেখানে রাজকীয় শানশওকত ও আরাম-আয়েশের কোনো বালাই নেই, প্রত্যেক নাগরিক অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন এবং ট্যাক্সের বোঝায় কোমর বাঁকা হওয়ার কারণ নেই। এমন অধিবাসীদের জন্যই কেবল সম্ভব ধর্ম ও জাতির স্বার্থে কাজ করা, চারিত্রিক ও রুহানি উন্নতি হাসিল করা।’
শাহ সাহেব (র.) হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা কিতাবে উল্লেখ করেন, ‘ঐতিহাসিক বাস্তবতা বলে, মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির সময় পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে উঠে গিয়েছিল, কিন্তু অর্থনৈতিক ন্যায্যতা না থাকার তার শিকড় ধীরে ধীরে মাটিশূন্য হয়ে যাচ্ছিল।’
‘তখন পৃথিবীর অবস্থা ছিল এমন মানুষ আরাম-আয়েশ ও মৌজ-মাস্তি আর সীমাতিক্রমী রাজকীয় ভোগবিলাসের রোগে আক্রান্ত ছিল। (যা রাষ্ট্র ও জাতির অর্থনৈতিক ন্যায্যতা ধ্বংস করে ফেলেছিল।) এ রোগ পারস্য, রোম ও অন্যান্য সাম্রাজ্যে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছিল।
আল্লাহতায়ালা তখন তার রাসূলের মনে এ বার্তা দিলেন, এ রোগের কেবল চিকিৎসা নয়, যেই বিষাক্ত জিনিস থেকে এর উৎপত্তি, তাকে সমূলে ধ্বংস করে ফেল। রাসূল (সা.) সেই জিনিসগুলো নিয়ে চিন্তা-ফিকির করেন-যেগুলোর কারণে এর জন্ম, তারপর এক এক করে চিহ্নিত করে সবগুলোকে নিষিদ্ধ করেন।’
রাসূল (সা.) তার জীবদ্দশায় প্রায় পুরো হেজাজের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নেহাত সাদাসিধা। এবং তিনি ভোগবাদী মানসিকতার জন্ম নিতে পারে এমন প্রত্যেকটি ধারণাই নিষিদ্ধ করেছিলেন।
তিনি যেভাবে আল্লাহর বাণীকে কার্যত বাস্তবায়ন করেন এবং তার নীতিতে পরবর্তী চার খলিফা যেভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন, এখান থেকেই স্পষ্ট হয় আল্লাহতায়ালা কেন তাকে ‘রহমত’ খেতাবে ভূষিত করেছেন। তিনি ভোগবাদ নির্মূল করে সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের পথিকৃৎ ছিলেন।
মানুষকে জুলুম থেকে রক্ষা করার যে পয়গাম নিয়ে মুহাম্মাদ (সা.) প্রেরিত হয়েছিলেন, সেই দায়িত্ব আমাদের ওপরেও বর্তানো হয়েছে, এবং সেই হিসাবে আমরাও পৃথিবীর জন্য রহমত। কেননা রাসূল (সা.)-এর পথ ও আমাদের পথ এক ও অভিন্ন।
কুরআনে ইরশাদ আছে-(হে নবি) আপনি বলে দিন, আমার পথ তো এটাই, আমি আল্লাহর দিকে ডাকি, আমি নিজেও স্পষ্ট জ্ঞানের আলোকে নিজের পথ দেখছি এবং আমার সাথিরাও তা-ই। (সূরা ইউসুফ, আয়াত ১০৮)।
সাহাবায়ে কেরাম এ কথা মনেপ্রাণে ধারণ করতেন। এ কারণেই সাহাবি রবি বিন আমের পারস্য সেনাপতি রুস্তমকে বলেছিলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ আমাদেরকে পাঠিয়েছেন, যেন আমরা মানুষদের মানুষের গোলামি থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দিকে নিয়ে যেতে পারি ও সংকীর্ণতা থেকে অবমুক্ত করতে পারি এবং বাতিল ধর্ম ও মতবাদের জুলুম থেকে ইসলামের ন্যায়নিষ্ঠা ও ইনসাফের দিকে নিয়ে যেতে পারি।’ অথচ আজ রহমতের নবির প্রতি ভালোবাসা ও অনুসরণের অভাবে খোদ আমরাই ডুবে আছি জুলুমের গহিন অন্ধকারে।
