|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পুরুষ ঘর বাঁধে আর নারী সংসার সাজায়। ভালোবাসা দিয়ে সবাইকে আগলে রাখে। ইহজীবন ও পরজীবনে দুজনের গুরুত্বই সমান। তবু যুগে যুগে মানুষ প্রথা ও ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে ছোট করার চেষ্টা করেছে। অথচ স্রষ্টা এ পৃথিবী সাজিয়েছেন নারী পুরুষের সমান আবাসস্থল হিসাবে। উভয়কেই দিয়েছেন খলিফার মর্যাদা।
কুরআনুল কারিমে সূরাতুন নিসা বা নারীদের সূরা নামে একটি সূরার নামকরণ করেছেন। তবে সূরাতুল রিজাল বা পুরুষের সূরা নামে নেই কোনো সূরা। দায়িত্ব-কর্তব্য কারও থেকে কারও কম নয়। বরং কোথাও কোথাও নারীদের দায়িত্ব-কর্তব্য একটু বেশিই থাকে।
পরিবার গোছানো ও সন্তান লালনপালন থেকে শুরু করে পৃথিবী সাজানোর দায়িত্ব যেন নারীদের কাঁধেই তুলে দিয়েছেন স্বয়ং সুবহানাহুতায়ালা।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পেতে পার। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে সে জাতির জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে, যারা চিন্তাভাবনা করে।’ (সূরা রুম, আয়াত : ২১)।
ইতিহাস সাক্ষী, ইসলামপূর্ব যুগে নারী জাতিকে মনে করা হতো অপমান ও অবমাননার বস্তু এবং নরকে প্রবেশের দরজা। তাই মেয়েশিশু জন্মের পরপরই পুরো পরিবারে আঁধার নেমে আসত। বোবা কান্নায় কেঁপে উঠত মায়ের কোমল হৃদয়। এই বুঝি নিয়ে যাওয়া হবে কবরস্থ করতে তার আদরের দুলালীকে।
নিরুপায় মা কান্নায় বুক ভেজাতেন আর বাবা নিয়ে যেতেন মাটিচাপা দিতে। এ দৃশ্যে কেঁপে উঠত খোদার আরশ। তবু সামাজিক কুপ্রথায় বাঁধা বাবার পাশান হৃদয়ে কোনো মায়া-মমতার উদ্রেক হতো না। বড় করুণ এ দৃশ্যপট উঠে এসেছে কুরআনের বর্ণনায়, ‘তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হলে তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ভুগতে থাকে।
সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে নিজ সম্প্রদায় থেকে লুকিয়ে বেড়ায় আর ভাবে, হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। কত নিকৃষ্ট ছিল তাদের সিদ্ধান্ত। (সূরা নাহল, আয়াত : ৫৮-৫৯)। কুরআনুল কারিমের এ আয়াতে নারীর জন্মকে সুসংবাদ বলা হয়েছে। অথচ জাহেলি সমাজের মতো আজও কেউ কেউ মেয়েশিশুর জন্মকে দুঃসংবাদ মনে করে।
মায়ার নবিজি কন্যাশিশুর প্রতিপালনে জান্নাতের গ্যারান্টি প্রদান করেছেন। জাহেলি প্রথাকে মূলৎপাটন করে নারীদের সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। অন্ধকার থেকে নারীকে আলোর পথ বিনির্মাণে সহযাত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন। পুরুষের পাশাপাশি ঘর গোছানো থেকে নিয়ে সেনাবাহিনী সজ্জিত করার গুরু দায়িত্বও নারীদের দিয়েছেন। পুরুষের অর্থনৈতিক দুর্দশায় সাপোর্ট দিতে নারীদেরও কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন। ইসলামের সোনালি অতীত সেসব স্বাক্ষর বহন করছে আজও।
সহিহ বুখারি ও মুসলিমসহ হাদিস গ্রন্থের পাতায় পাতায় রয়েছে জাহেলিয়াতের আঁধার ছাপিয়ে নবিজির সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণে নারীর অবদানের কথা। এমনই একটি ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ সব সময় জ্ঞানার্জনে ব্যস্ত থাকতেন। সংসারের দেখভাল করার সময় তেমন পেতেন না। ফলে পরিবারের অর্থনৈতিক জোগান দিতে তার স্ত্রী নিজেই নকশা করা বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতেন ও সংসার চালাতেন। একবার তিনি নবিজির কাছে জানতে চাইলেন, আমি কি এ কাজ করে আমার সংসারের জন্য ব্যয় করতে পারি? নবিজি জবাব দেন, অবশ্যই পার। বরং এতে তুমি পুরস্কার পাবে। প্রিয় পাঠক, লক্ষ করুন, নবিজি নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে কী চমৎকারভাবে উৎসাহ প্রদান করেছেন।
আরেকটি ঘটনা এসেছে সহিহ বুখারির বর্ণনায়, হজরত আবু বকর (রা.)-এর কন্যা আসমা ও তার জামাতা আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়েরের ছিল অভাব অনটনের সংসার। নবিজি এ অবস্থা দেখে তাদের একখণ্ড জমি দান করলেন। জমিটি ছিল তাদের বাড়ি থেকে দুই মাইল দূরে। খেজুর সংগ্রহের দিনে আসমা (রা.) সেখান থেকে খেজুরের আঁটি বেঁধে ঝুড়ি বহন করে ফিরছিলেন। পথে নবিজি (সা.) ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। আসমা (রা.) তার স্বামীর আত্মমর্যাদার কথা ভেবে লজ্জা পাচ্ছিলেন নবিজির সঙ্গে পথ চলতে। নবিজি (সা.) বুঝতে পেরে পথ পরিবর্তন করে চলে গেলেন, (বুখারি)। দেখুন, নারীদের কাজের পথ নির্বিঘ্ন করতে তিনি কত সচেষ্ট ছিলেন।
সভ্যতা বিনির্মাণে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অবদান ইসলাম কখনো খাটো করে দেখেনি। বরং উৎসাহ ও উদ্দীপনা দিয়ে নারীকে সাহস জুগিয়েছে। নারীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত নয়। এমনকি মুসলিম অধ্যুষিত সমাজ ও রাষ্ট্রে পর্যন্ত নারীদের অধিকার আরও বেশি উপেক্ষিত হচ্ছে। মূলত ইসলামি সভ্যতার পতনের কারণেই আজ নারী অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। একশ্রেণির মানুষ কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করে ধর্মপালনেও নারীর অবস্থান সীমিত করে দিয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসা ও জ্ঞানচর্চার সোনালি আসন থেকে নারীকে বঞ্চিত করেছে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও ইবাদত পালনে বিধিনিষেধ আরোপ করে দিয়েছে। যা নারীকে অন্ধকারের পথে ধাবিত করছে। ফলে সুবিধাভোগী মানুষের দাসীতে পরিণত হচ্ছে আজকের নারী জাতি। করপোরেট বাজারের চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপনের কাছে হেরে যাচ্ছে নারীর সম্মান। অথচ এভাবে নারীর সম্মান ভূলুণ্ঠিত হতে থাকলে অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাবে আমাদের সমাজ ও সভ্যতা। তাই নবি আদর্শের ভিত্তিতে নারী অধিকার নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সোনালি সমাজ বিনির্মাণ ও আদর্শ জাতি গঠনে নারীকে তার সর্বোচ্চ সম্মানের আসন ফিরিয়ে দিতে হবে। তবেই অন্ধকার পেরিয়ে আলো ফুটবে। আগামীর পৃথিবী হবে সুশোভিত ফুলের মতো।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
akpatwary.qp@gmail.com
