নবীর তরিকায় দ্বীনের মেহনত
তানজিল আমির
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইসলাম হল আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান। এর ধারক-বাহক হল মুসলমান। মুসলমান এমন এক সম্প্রদায় ও জাতির নাম, যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ এক পয়গাম ও দ্বীন নিয়ে দুনিয়াতে এসেছেন। পবিত্র কোরআনের বাণী এবং হাদিসের বিবরণে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, মুসলিম উম্মাহকে এই উদ্দেশ্যেই দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়েছে যেন তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুবর্তিতা এবং তাঁর তরিকা অনুযায়ী দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনত তথা আমর বিল মা’রুফ ও নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন করে। যেমন কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে।’ (সূরা আল ইমরান; ১১০)। এ আয়াতের মর্ম হল মানুষকে ন্যায়-কল্যাণ ও সত্যের পথে আহ্বান এবং অন্যায়-অসত্য ও অকল্যাণের প্রতিরোধ তথা বিশ্বমানবের কল্যাণ ও হেদায়াতের মাধ্যমে মানবজাতির উপকারের জন্যই এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। সুতরাং মুসলিম উম্মাহ যদি এই দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে তবে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতাই প্রমাণিত হবে। মুসলমানরা সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কর্মের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নবীর স্থলবর্তী। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবুয়াতের যে তিনটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ- (১) শরীয়তের আহকামের পাঠদান, (২) কিতাব ও হিকমতের তালিম এবং (৩) তাজকিয়া ও আত্মসংশোধন- এই তিনটি কাজ মুসলমানের ওপরও ফরজে কিফায়া। পূর্ববর্তী মনীষীরা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের মহান ত্যাগ ও কোরবানির ফলেই আমরা দ্বীনের নুরপ্রাপ্ত হয়েছি। পবিত্র কোরআনে আলোচ্য তিনটি দায়িত্বের কথা এভাবে বিবৃত হয়েছে- ‘তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসূল যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতগুলো, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত’। (সূরা জুময়া; ২) । নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচ্য তিনটি দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। মানুষকে তিনি আহকামে ইলাহি ও আয়াতে রাব্বানি পাঠ করে শুনিয়েছেন এবং হিকমত শিক্ষা দিয়েছেন। আর এতটুক করেই তিনি নিজের দায়িত্ব শেষ করেননি; বরং নিজের পবিত্র সোহবত ও রুহানি ফয়েজ দিয়ে মানুষের আত্মার সংশোধন করেছেন। জাহেরি-বাতেনি ইসলাহের মাধ্যমে মানুষকে সর্ববিধ কলুষতামুক্ত করেছেন। এভাবে নববী পরশের আলোকে মানুষের আধ্যাত্ম ও বাহ্যজগৎ সমান গুরুত্বের সঙ্গে পরিচর্যা পেয়েছিল। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের যুগ পর্যন্ত মানুষের জাহের-বাতেন সংশোধনের এ ধারার অভিন্ন গুরুত্ব ও লালন অব্যাহত ছিল। কিন্তু এরপর ইসলামী দুনিয়ায় এমন এক যুগের সূচনা হল যখন জাহেরি ইলমের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা বাতেনি জগৎ থেকে ছিটকে পড়লেন এবং বাতেনি জগতের মহাপুরুষরা জাহেরি জগতের ইলম ও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সরে পড়লেন। অতঃপর জাহের-বাতেনের এই ব্যবধান ক্রমশ বৃদ্ধিই পেতে থাকল। অবশেষে জাহেরি ইলমের জন্য মাদ্রাসা এবং বাতেনি ইলম ও আত্মশুদ্ধির জন্য খানকার পৃথক নিবাস গড়ে উঠল। ফলে মসজিদে নববী-মুসলমানদের স্বর্ণযুগে যা ছিল জাহের-বাতেন উভয় ধারার নুরের কেন্দ্রবিন্দু; তাঁর নুরের বিভা মাদ্রাসা ও খানকায় বিভক্ত হয়ে পড়ল। এর স্বাভাবিক পরিণতিতে মাদ্রাসা থেকে আলেমে দ্বীন বের হওয়ার পরিবর্তে দুনিয়াদার আলেম বের হওয়া শুরু হল এবং খানকার সাধকরা ইলম ও শরিয়তের রহস্যভেদী প্রজ্ঞা থেকে বঞ্চিত হতে লাগল। ইসলামের স্বর্ণযুগের যে চিত্র এতক্ষণ তুলে ধরা হল, এরপরও কিছু ব্যতিক্রমী মহাপুরুষের আবির্ভাবের ধারা অব্যাহত ছিল- যাদের দিলে সফলভাবেই নুরে নবুয়াতের উভয় ধারার সমাবেশ ঘটেছিল। এ কথায় সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, যেসব মহাপুরুষের দিলে নূরে নবুয়াতের এই উভয় ধারার যুগপৎ সমাবেশ ছিল, মূলত তাদের দিয়েই ইসলামের যথার্থ বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেছে। এ ধারাতেই পৃথিবী চলছিল। সতেরশ শতাব্দীতে যখন উপমহাদেশ ছিল ইংরেজদের শোষণে নিষ্পেষিত। ইংরেজরা মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষা, কৃষ্টি কালচার সব কিছুতেই হানা দিয়েছিল আগ্রাসীভাবে। উপমহাদেশের মুসলমানরা দীর্ঘ দু’শত বছর ধর্মীয় শিক্ষা, সভ্যতা স্বাধীনভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বীনের সঠিক বোধ থেকে তারা দূরে সরে যায়, নিমজ্জিত হয় বিভিন্ন কুসংস্কার ও সামাজিক ব্যাধিতে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের এমন চরম ক্রান্তিলগ্নে তাবলিগ জামাতের কাজ শুরু করেন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)। ব্রিটিশ শাসনের ফলে চারিত্রিকভাবে বিপর্যস্ত ধর্মকর্মহীন, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন নামেমাত্র মুসলমানদের ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন ও কালেমার মর্ম শিক্ষাদান এবং বিভ্রান্তির কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি এ কাজ শুরু করেন। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) তাবলিগ নামে নতুন কোনো মতবাদের উদ্ভাবন ঘটাননি, বরং যুগে যুগে মহান সংস্কারকগণ যেভাবে উম্মতকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন, সে ধারাতেই উনিশ শতকের জন্য আল্লাহ ইলিয়াস (রহ.) কে কবুল করেছেন। কাজের জন্য নতুন কোনো পদ্ধতি বা অভিনব কিছু করার পরিবর্তে তিনি সুন্নতের অনুসরণকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ বাস্তব সত্য হল, প্রত্যেক জাতিরই কিছু নিজস্ব স্বভাব-প্রকৃতি থাকে। কোনো জাতির সংশোধনের চেষ্টা যদি সে জাতির স্বভাব-প্রকৃতি অনুযায়ী করা না হয়, তবে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। উম্মতে মুহাম্মাদির সংস্কার কার্যক্রমের ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় বিবেচ্য বিষয় হল, এই উম্মতের স্বভাব-প্রকৃতি অনুযায়ী দ্বীনের দাঈ, দাওয়াত এবং দাওয়াতের পদ্ধতি- এই তিনটি বিষয়ই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরিকা অনুযায়ী হতে হবে। সিরাত-সুরত তথা আকৃতি-প্রকৃতিতে এখনকার দাঈকে ইসলামের প্রথম দাঈ হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকৃতি-প্রকৃতির পূর্ণাঙ্গ অনুসারি হতে হবে। এ অনুসরণ যতটা হুবহু ও যথার্থ হবে দাওয়াতের প্রভাব ও কার্যকারিতা সে অনুপাতে বৃদ্ধি পাবে। মানুষকে দাওয়াত দিতে হবে খালেস ইসলাম, ঈমান ও নেক আমলের প্রতি। ইসলামের প্রথম দাঈ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পদ্ধতিতে মানুষকে দ্বীনের পথে দাওয়াত দিয়েছেন আজকের দাঈকেও সে পদ্ধতি অনুযায়ী দাওয়াতের আমল করতে হবে। এটিই ছিল হজরতজি ইলিয়াস (রহ.)-এর দ্বীনি জাগরণের মূল দর্শন। দ্বীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে পয়গম্বরগণের কয়েকটি ধারা কোরআনে পাওয়া যায়। হজরতজি (রহ.)-এর আলোকেই তাবলিগের মেহনতকে সাজাতে চেয়েছেন। নবী রাসূলগণের দাওয়াত ও তাবলিগের ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল যে, তারা কোনো মানুষের কাছে আমল ও কর্মের বিনিময় প্রার্থনা করতেন না। যেমন ইরশাদ হয়েছে ‘আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো বিশ্ব-পালনকর্তাই দেবেন।’ (সূরা শুয়ারা : ১৮০)। কাদের অনুসরণ করতে হবে, সে বিষয়ে সূরা ইয়াসিনে আল্লাহ বলছেন, ‘অনুসরণ কর তাদের যারা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় প্রার্থনা করে না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, চরিত্রের পবিত্রতা, ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত এবং মানুষের থেকে কোনোরকম বিনিময় পাওয়ার ব্যাপারে পরিপূর্ণ বিমুখতাই হল দাঈ ও মুবাল্লিগের দাওয়াতের সাফল্য ও কার্যকারিতার মূল উৎস।
বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের ঈমানি জাগরণ ও ধর্মের প্রতি আগ্রহী করতে তাবলিগ জামাতের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বস্তুবাদের জয়জয়কারের যুগে ঈমানি শক্তির নবজাগরণ ঘটিয়েছে তাবলিগ জামাত। যার বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় আমাদের বাংলাদেশে। এই ইজতেমার মূল লক্ষ্য হল মানুষের মাঝে ঈমানি প্রেরণা সৃষ্টি করা। আল্লাহভোলা বান্দাদের জুড়িয়ে দেয়া আল্লাহর সঙ্গে।
tanjil.amir@yahoo.com
