আল-কুরআনে রুহ প্রসঙ্গ
মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রুহ বা আত্মা কী? আত্মার পরিচয় না জেনে আত্মার শান্তি নিরন্তর খুঁজে চলেছে মানুষ মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায়, প্যাগোডায়, খানাকায়, জঙ্গলে, মরুভূমিতে, পাহাড়ে, আহারে, বিহারে, সংসারে, সন্ন্যাসে। আর এ খোঁজাখুঁজির পথ ধরে সৃষ্টি হয়েছে বহু ধর্মমতের, জন্ম হয়েছে অনেক দর্শনের। কিন্তু আত্মার পরিচয়টাই যদি না জানা গেল, তাহলে তার শান্তির সন্ধান করাটা অবান্তর নয় কি? মানবাত্মার আসল পরিচয়টা তো কেবল তিনিই দিতে পারেন, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং আত্মার যথার্থ পরিচয়টা মহান আল্লাহর কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব। কারণ তিনিই সমগ্র জগতের একমাত্র স্রষ্টা। মানবাত্মার পরিচয় পর্বের আগে জানা দরকার মানব সৃষ্টির পর্যায় ক্রমিক পর্বগুলো সম্পর্কে।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এবং কাদামাটি থেকে মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন।’ (সূরা আস-সাজদাহ : ৭)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন, তাদেরকে সৃষ্টি করাই বেশি কঠিন না আমি অন্যান্য যা কিছু সৃষ্টি করেছি? আমি তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এঁটেল মাটি থেকে। (সূরা আস-সাফফাত : ১১)। উদ্ধৃত আয়াতদ্বয়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে, মানুষের সৃষ্টির মূল উপাদান হলো মাটি। শায়খুল হাদিস আল্লামা মরহুম আজিজুল হক (রহ.) ‘বুখারি শরিফ’-এর ৪র্থ খণ্ডে লিখেছেন, মানব জাতির আদি পিতা আদম (আ.)-এর দেহকে আল্লাহতায়ালা মাটি দ্বারা তৈরি করিবেন তাহা পূর্ব বর্ণিত আয়াতদ্বয়ে স্বয়ং আল্লাহতায়ালার ঘোষণায়ই জানা গিয়াছে। এ সম্পর্কে এক হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত রাসূল (সা.) ফরমাইয়াছেন, আল্লাহতায়ালা আদমকে যেই মাটিটুকু দ্বারা তৈরি করিয়াছেন, সেই মাটিটুকু ভূ-মণ্ডলের বিভিন্ন অংশ হইতে সংগৃহীত হইয়াছিল (যাহার মধ্যে লাল, সাদা, কালো এবং নরম, শক্ত, মন্দ ও ভালো বিভিন্ন রকমের মাটি ছিল। যার ফলে আদম সন্তানরা লাল, সাদা, কালো, নরম এবং শক্ত ও ভালো-মন্দে বিভক্ত হইয়াছে।
এ পর্যায়ে আমরা পার্থিব প্রজননরীতিতে মানব জন্মের পরিক্রমা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন, ‘আর স্মরণ করো সে সময়ের কথা যখন তোমার পালনকর্তা ফেরেশতাদের বললেন, আমি কাদা থেকে প্রস্তুতকৃত ঠনঠনে মাটি দ্বারা তৈরি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। অতঃপর যখন আমি তাকে আকৃতি দান করব এবং তার মধ্যে আমার রুহ থেকে ফুঁক দেব তখন তোমরা তার জন্য সিজদায় পতিত হবে। (সূরা আল-হিজর : ২৮, ২৯)। পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আমরা মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমরা তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে (জরায়ুতে) স্থাপন করেছি। এরপর শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কতই না কল্যাণময়!’ (সূরা আল-মুমিনুন : ১২-১৪)। মহান আল্লাহ আরও ইরশাদ করেছেন, ‘অতঃপর তিনি তাকে সুসম করেন, তাতে রুহ সঞ্চার করেন এবং তোমাদেরকে দেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ। তোমরা সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সূরা আস-সাজদাহ : ৯)। তাফসিরে মায়ারিফুল কুরআনে মানব সৃষ্টির সাতটি স্তরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্তরগুলো হলো ১. মাটির সারাংশ ২. বীর্য ৩. জমাট রক্ত ৪. মাংসপিণ্ড ৫. অস্থি পিঞ্জর ৬. অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃতকরণ ৭. রুহ বা আত্মা সঞ্চালন। বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মাতৃগর্ভে মানবশিশু জন্মের স্তরগুলো সম্পর্কে বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্য আকারে ৪০ দিন, জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হওয়ার পর ৪০ দিন, মাংস আকারে ৪০ দিন থাকে। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন যে, তার (শিশুর) আমল, রিজিক, হায়াত ও ভালো-মন্দ সবকিছু লিপিবদ্ধ কর।। অতঃপর তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেওয়া হয়। (সহিহ আল-বুখারি : ২৯৬৮)।
মোট কথা, মাটি অতঃপর পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মানুষের দেহ বা কায়া সৃষ্টি হয় এরপর তার মধ্যে রুহ বা আত্মা ফুঁকে দিলে সে হয় পূর্ণাঙ্গ মানুষ। আত্মার সংযোগ ছাড়া কায়া বা দেহকে মানুষ বলা হয় না, বলা হয় মৃত বা লাশ। রুহ বা আত্মাই যখন আসল মানুষ, তখন আত্মা বা রুহের প্রকৃতি ও পরিচয় জানাটা সব থেকে জরুরি। রুহের পরিচয় সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘আর তারা তোমাকে রুহ (আত্মা) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে, বলে দাও, রুহ হলো আমার রবের আদেশ। আর তোমাদের খুব সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে। (সূরা বানি ইসরাইল : ৮৫)। রুহ সম্পর্কে যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সূরা বানি ইসরাইলের ৮৫ নাম্বার আয়াত। আলোচ্য আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসিকার আল্লামা আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার আমি রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে মদিনার খেতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। রাসূল (সা.)-এর হাতে একখানা খেজুরের ডালের ছড়ি ছিল। চলতে চলতে তিনি ইয়াহুদিদের এক দল লোকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তারা পরস্পর একে অন্যকে বলল, তোমরা তার কাছে রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন কর। কেউ কেউ বলল, তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করো না। রাবী বলেন, অতঃপর তারা রুহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল, তারা বলল, হে মুহম্মাদ! রুহ কী? রাসূল (সা.) ছড়ির ওপর ভর দিয়ে থাকলেন। রাবী বলেন, আমি ধারণা করলাম, এখন তার ওপর ওহি অবতীর্ণ হবে। অতঃপর তিনি বলেন, ‘তোমাকে উহারা রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, রুহ আমার প্রতিপালকের আদেশ ঘটিত। এবং তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দেওয়া হয়েছে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড : ৬, পৃষ্ঠা : ৩৬৫)। আল্লামা ইকবাল উদ্ধৃত আয়াতের অনুবাদ করেছেন এভাবে, ‘তারা তোমাকে আত্মার কথা জিজ্ঞেস করছে। বল, আত্মা আমার প্রভুর ‘আমর’ (আদেশ) থেকে উদ্ভূত; কিন্তু জ্ঞানের মাত্র সামান্য অংশই তোমাদের দেওয়া হয়েছে।’ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্যার ইকবাল লিখেছেন, ‘উদ্ধৃত বাক্যের অর্থ এই যে, আত্মার মৌলিক প্রকৃতি হলো নির্দেশাত্মক; কেননা আত্মা আসছে আল্লার নির্দেশমূলক স্পৃহা থেকে। অবশ্য ঐশী ‘আমর’ খুদীরূপে কীভাবে কাজ করে তা আমাদের জানা নেই। খুদীর প্রকৃতি ও আচরণ সম্পর্কে আরও কিছু আলোক সম্পাত হয় ‘রাব্বী’ (আমার প্রভু) কথাটিতে যেভাবে ‘আমর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তার থেকে। এর অর্থ হলো আত্মার একত্বের সীমা, সামঞ্জস্য বা কার্যকারিতার সহস্র বিভিন্নতা সত্ত্বেও তাকে যে একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট কিছু বলে মেনে নিতে হবে তার প্রতি কুরআনে ইঙ্গিত রয়েছে। (ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন : ৯৭)
লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ।
