Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

শতবর্ষী আলোর মিনার দারুল উলূম হাটহাজারী

Icon

গোলাম রাসূল

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শতবর্ষী আলোর মিনার দারুল উলূম হাটহাজারী

চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের মনোরম প্রকৃতিতে টানা একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার যে দীপ্ত শিখা জ্বলছে, তার নাম হাটহাজারী মাদ্রাসা। প্রাতিষ্ঠানিক নাম আল-জামিয়া আল-আহলিয়া দাওরুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী। তবে এ নামের বাইরেও রয়েছে আরেকটি পরিচয়, এটি বাংলাদেশর প্রথম কওমি মাদ্রাসা।

কালের স্রোতে বদলেছে বহু কিছু; তবে বদলায়নি এ মাদ্রাসার মূল আদর্শ, মূল মিশন। এখানেই ইসলামি জ্ঞানের সেই বীজ রোপণ করা হয়েছিল, যা পরবর্তী শতকে মহিরুহ হয়ে ছায়া দিয়েছে লক্ষ-কোটি মুমিন মুসলমানের জীবনে।

১৯০১ সালে দেওবন্দি চিন্তাধারার ধারক, বিখ্যাত বুজুর্গ মাওলানা হাবীবুল্লাহ (রহ.) প্রতিষ্ঠা করেন এই মাদ্রাসা। তখন এটি ছিল একচালা ঘরে গড়া একটি সাধারণ পাঠশালা। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতার অন্তর্দৃষ্টি এবং আল্লাহর তাওফিকে তা রূপ নেয় একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রে, যা বাংলাদেশের ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও চিন্তা ধারাকে আমূল প্রভাবিত করেছে। এখান থেকে ফুটে উঠেছে এমন সব আলোকবর্তিকা, যাদের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে ইসলামি সমাজ জাগরণের ভিত্তি।

হাটহাজারী মাদ্রাসার পাঠক্রম কোনো বই বা শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে শুরু হয় নূরানি কায়দা থেকে, শেষ হয় সাহিহ বুখারির দরস দিয়ে। হিফজ, নাজেরা, ফিকহ, হাদিস, তাফসির, বালাগাত, মান্তিক ইসলামি জ্ঞানের যত শাখা, সবই এখানে অধ্যয়ন করা হয় গভীর নিষ্ঠায়। এটি শুধু একটি বিদ্যাপীঠ নয়, বরং একটি জীবনদর্শনের কেন্দ্র। এখানকার ছাত্ররা সকাল থেকে রাত অবধি একটি সময়ানুগ রুটিনে জীবন পরিচালনা করে। তাদের ঘুম, খাওয়া, পড়াশোনা, ইবাদত সবই চলে নিয়মমাফিক। এ শৃঙ্খলা তাদের চরিত্রে আনয়ন করে আত্মনিয়ন্ত্রণ, বিনয় ও তাকওয়ার ছাপ।

এ প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ইতিহাসে অনেক আলেম এসেছেন, গেছেন। তবে সবচেয়ে আলোচিত ও দীর্ঘ সময় মুহতামিম হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন শায়খুল হাদিস আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)। প্রায় চার দশক তিনি এই মাদ্রাসার প্রশাসনিক, শিক্ষাগত ও নৈতিক দায়িত্বে ছিলেন। তার হাতে মাদ্রাসাটি পেয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন দেশের ইসলামি আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সূচনা হয় তার দিকনির্দেশনায়, আর তার সংগঠন এ মাদ্রাসাকেই বেছে নেয় ইসলামি মূল্যবোধের মজবুত ঘাঁটি হিসাবে।

২০২০ সালে আল্লামা আহমদ শফী (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর মাদ্রাসায় দেখা দেয় অস্থিরতা। ছাত্র বিক্ষোভ, নেতৃত্ব সংকট ও প্রশাসনিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নবনির্বাচিত শুরা কমিটির মাধ্যমে আবার স্থিতি ফিরে আসে। নতুন করে পথচলা শুরু হয়, পুরোনো আস্থা ও সম্মানের জায়গাটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

হাটহাজারী মাদ্রাসার আরেকটি যুগান্তকারী অর্জন হলো, কওমি সনদের স্বীকৃতি আন্দোলনে নেতৃত্বদান। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কওমি দাওরায়ে হাদিস সনদকে ইসলামি স্ট্যাডিজ বিষয়ে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেয়। এ স্বীকৃতি শুধু একটি কাগুজে অনুমোদন নয়; এটি ছিল বহু বছরের আন্দোলন ও লড়াইয়ের ফল। এখানকার হাজার হাজার আলেম এখন জাতীয়ভাবে স্বীকৃত, যা তাদের জাতীয় জীবনে অবদান রাখার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে।

এ মাদ্রাসার ছাত্ররা শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে ইসলামের দাওয়াহ ও শিক্ষাবিস্তারে কাজ করছেন। সৌদি আরব, ইউরোপ, আফ্রিকা, মালয়েশিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্র সবখানেই ছড়িয়ে আছেন হাটহাজারীর শিক্ষালাভকারী আলেমরা। তাদের মধ্যে কেউ শিক্ষক, কেউ মুফতি, কেউ গবেষক, কেউবা সমাজ সংগঠক। তারা যে শুধু অ্যাকাডেমিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ তা-ই নয়; তাদের ভেতরে আছে একটি আত্মিক বল, যা হাটহাজারীর চার দেওয়ালের মধ্যেই গড়ে ওঠে।

তবে বাস্তবতা হলো, অনেক সময় কওমি মাদ্রাসাগুলোর বিরুদ্ধে কিছু নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয় ‘প্রাচীন’, ‘উগ্র’ বা ‘বিচ্ছিন্ন’ বলেও। কিন্তু হাটহাজারী মাদ্রাসা এসব প্রচারণার বাইরে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এটি কোনো রাজনৈতিক দলের দোসর নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া ও আদর্শিক ধারার এক আশ্রয়স্থল। এখানে আদর্শিক প্রভাব ও নৈতিক নেতৃত্ব গঠনের কাজ চলে নীরবে, নিষ্ঠায়।

বাংলাদেশের আজকের নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংকটের মুহূর্তে হাটহাজারী মাদ্রাসার ভূমিকা হতে পারে নতুন করে মূল্যায়নের বিষয়। শিক্ষা যদি হয় চরিত্র গঠনের হাতিয়ার, তাহলে এ মাদ্রাসা সে দায়িত্ব পালন করছে একশ বছর ধরে, কোনো সরকারি বরাদ্দ ছাড়াই। হাটহাজারী মাদ্রাসা কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়; এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস। এটি একটি চলমান রুহানি তাজদীদ আন্দোলন। এর পাঠশালা একদিকে যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার উন্মেষ ঘটায়, তেমনি আত্মার জগতে বুনে দেয় খোদাভীতির বীজ। এমন বাতিঘর যুগে যুগে একেকটি জাতির ভাগ্যবদলের কারিগর হয়। হাটহাজারী মাদ্রাসাও তেমনি এক বাতিঘর, যা অন্ধকারে আলোর সন্ধান দেয়, বিভ্রান্তি ও বিভেদে দেখায় ঐক্যের দিক।

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

দারুল উলূম হাটহাজারী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম