জুনায়েদ জামশেদের দ্বীনে ফেরার গল্প
মারিয়াম আক্তার মৌসুমি
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একটি জীবন, দুটি বিপরীত স্রোত। একদিকে গ্ল্যামার, স্টেজের আলো, হাজারও কণ্ঠের সমবেত উল্লাস; অন্যদিকে নীরবতা, আত্মসমর্পণ, হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত নাতের সুর। এ দুই স্রোতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন জুনায়েদ জামশেদ। উপমহাদেশের এক অনন্য প্রতিভা, যিনি এক জীবনে ভোগ করেছেন বহু জীবনের স্বাদ।
১৯৬৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করাচিতে জন্ম নেওয়া জুনায়েদ প্রথমে স্বপ্ন দেখেছিলেন পাইলট হওয়ার। পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে যোগ দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হলে যন্ত্র প্রকৌশলে পড়াশোনা করেন লাহোরের ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে। পড়াশোনার ফাঁকে শখের বসে গাইতে গাইতেই পরিচয় হয় রোহেল হায়াত ও শেহজাদ হাসানের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে গড়ে তোলেন পাকিস্তানের প্রথম পপ ব্যান্ড ‘ভাইটাল সাইনস’।
১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘ভাইটাল সাইনস ১’। এ অ্যালবামের ‘দিল দিল পাকিস্তান’ গানটি রাতারাতি জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়। জুনায়েদের কণ্ঠে ‘তুম মিল গায়ে’ কিংবা ‘ও সানামা’ সবই হয়ে ওঠে প্রজন্মের কণ্ঠস্বর।
কিন্তু যখন ক্যারিয়ারের শিখরে, তখনই এক অভ্যন্তরীণ প্রশ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় : ‘আমি কি আজীবন শুধু গানই গেয়ে যাব?’ এ আত্মজিজ্ঞাসা তাকে নিয়ে আসে এক নতুন পথে।
২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সংগীতজগৎকে বিদায় জানান জুনায়েদ। তিনি বলেন, ‘জীবনের আসল উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে চাই।’ এরপর তিনি যুক্ত হন তাবলিগ জামাতের সঙ্গে, শুরু করেন নবীজির প্রশংসায় নাত গাওয়া। ‘মেরা দিল বদল দে’, ‘মুহাম্মদ কা রওজা’ এ গজলগুলো আবারও তাকে এনে দেয় জনপ্রিয়তা।
জুনায়েদের জীবনে এ পরিবর্তনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন প্রখ্যাত আলেম মাওলানা তারেক জামিল। তিনি বলেন, ‘জুনায়েদ যখন সংগীত ছাড়ার সিদ্ধান্তে দোদুল্যমান ছিল, আমি তাকে বলেছিলাম, মুখ ঢেকে হলেও আমার কাছে আসো, কিন্তু দ্বীনের পথ থেকে দূরে সরে যেও না।’
সংগীত ছাড়ার পরও জুনায়েদ থেমে থাকেননি। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘জে ডট’, যা পাকিস্তানসহ বিদেশেও জনপ্রিয়তা পায়। একইসঙ্গে তিনি যুক্ত হন বিভিন্ন দাতব্য কর্মকাণ্ডে, মুসলিম চ্যারিটির সঙ্গে কাজ করেন ১৬টি দেশে।
২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর, চিত্রাল থেকে ইসলামাবাদ ফেরার পথে পিআইএ ফ্লাইট ৬৬১ দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এ দুর্ঘটনায় জুনায়েদ ও তার স্ত্রীসহ ৪৭ যাত্রী নিহত হন। চিত্রালে তাবলিগ জামাতের মিশনে ছিলেন তিনি। এ দুর্ঘটনা পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা হিসাবে বিবেচিত।
জুনায়েদ জামশেদের জীবন ছিল এক অনন্য যাত্রা সংগীত থেকে ধর্ম, গ্ল্যামার থেকে আত্মসমর্পণ। তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন মানুষ এক জীবনে কতভাবে নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারেন। তার কণ্ঠে যেমন ছিল প্রেমের গান, তেমনি ছিল ইমানের সুর। আজও তার গাওয়া ‘দিল দিল পাকিস্তান’ কিংবা ‘মেরা দিল বদল দে’ মানুষের হৃদয়ে বেজে ওঠে। জুনায়েদ জামশেদ ছিলেন, আছেন, থাকবেন এক জীবনে বহু জীবনের স্বাদ পাওয়া এক অনন্য মানুষ।
