Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

নজরুলের কবিতায় আজানের ধ্বনি

Icon

মমতাজ উদ্দিন আহমদ

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নজরুলের কবিতায় আজানের ধ্বনি

নজরুলের আজান-ভাবনা মুসলিম জাগরণ ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তার অনবদ্য সৃষ্টি ‘বাজ্ রে ভোরের সানাই’ গানটি শুধু একটি গান নয়, এটি আজানেরই এক বন্দনা এবং ইসলামের এক গভীর জাগরণী বার্তা। এই গান ও অন্যান্য রচনার মাধ্যমে নজরুল আজানকে কেবল একটি ধর্মীয় আহ্বান হিসাবে দেখেননি, বরং একে জাগরণ, আশা এবং সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরেছেন। নজরুলের আজান-ভাবনা মুসলিম জাগরণ ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো-

অজ্ঞতার নিদ্রা থেকে জাগরণ

নজরুল মনে করতেন, ভোরের আজান যেন রাতের শেষ প্রহরে ঘুম ভাঙানো সানাইয়ের সুর। এটি কেবল শারীরিক ঘুমই ভাঙায় না, বরং ‘নিদ্-মহলের আঁধার-পুর’ দ্বারা বোঝানো অজ্ঞানতা, আলস্য বা গাফিলতির অন্ধকার দূর করে মুসলিম উম্মাহ ও সমগ্র ইসলামি দুনিয়াকে জাগিয়ে তোলে। এটি আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মোচন ঘটায়।

তার অন্যান্য জাগরণী সংগীত যেমন ‘জাগো মুসাফির’ বা ‘তওহিদেরই মুর্শিদ আমার’-এও তিনি আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় ধরনের জাগরণের ডাক দিয়েছেন, যা ‘বাজ্লো কিরে ভোরের সানাই’ গানের মূল সুরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

আধ্যাত্মিক যাত্রার আহ্বান

নজরুল পার্থিব জীবনকে একটি সরাইখানার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে মানুষ ক্ষণিকের জন্য আশ্রয় নেয়। আজানের আহ্বান সরাইখানার সহযাত্রীদের একে অপরকে ‘বন্ধু জাগো!’ বলে ডাকার মতো, যা জগৎ সংসারকে জাগিয়ে তোলে।

এ জাগরণের মাধ্যমে মানুষ তার অজ্ঞানতার নীড় ছেড়ে ‘আধ্যাত্মিক গোলাপ-বন’ (গুলেস্তান) অর্থাৎ জান্নাত বা আধ্যাত্মিক পূর্ণতার দিকে উড়ে চলে। এটি কেবল শারীরিক ঘুম ভাঙা নয়, এটি আধ্যাত্মিক সচেতনতার উন্মোচন এবং মুক্তির আহ্বান।

আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা

আজান ইসলামের একটি মৌলিক স্তম্ভ এবং তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা। এর মাধ্যমে মুসলিমরা প্রতিদিন পাঁচবার আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও তার উপাসনার দিকে ধাবিত হয়। নজরুল আজানের ধ্বনিতে ইসলামের প্রতি ভক্তি, আনুগত্য, জ্ঞান, গৌরব এবং ইতিহাসের সন্ধান করেছেন। ‘লা শারিকালাহু’ (আল্লাহর কোনো শরিক নেই) বাক্যটি তাওহিদের মহিমা তুলে ধরে, যা আল্লাহর একত্ববাদের বন্যার মতো নেমে আসার ইঙ্গিত। তার ‘আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি ভয়’ গানেও তিনি আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেছেন।

ইসলামের বিশ্বব্যাপী প্রসার

আজানের ধ্বনিতে কাবা, হেরা গুহার জ্যোতি এবং ইসলামের বিশ্বব্যাপী প্রসারের চিত্র উঠে এসেছে। ‘হেরার জ্যোতি’ বলতে হেরা গুহায় ওহি নাজিলের মাধ্যমে ইসলামের যে আলো নেমে এসেছিল, তাকে বোঝানো হয়েছে।

কুরআনের আয়াত (সূরা আলাক ৯৬:১-৫)। উদ্ধৃত করে নজরুল জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়াকে স্মরণ করিয়েছেন, যা আধ্যাত্মিক আলোকায়ন ও জাগরণেরই প্রতীক।

আত্মত্যাগ, নতুন জাগরণ ও বীরত্ব

নজরুল আজানের মাধ্যমে ইসলামিক বীর ও মহাপুরুষদের (যেমন : খালেদ বিন ওয়ালিদ, তারিক বিন যিয়াদ, হজরত মূসা আ.) আত্মত্যাগের মহিমা তুলে ধরেছেন। ‘খুন-রঙিন ভূষা’ আত্মত্যাগের প্রতীক।

‘হাসীন ঊষা’ দ্বারা ইসলামের নবজাগরণকে বোঝানো হয়েছে এবং ‘নও-বেলালের শিঁরিন সুরে’ বলতে হজরত বোলাল (রা.)-এর মতো নতুন প্রজন্মের মুয়াজ্জিনদের সুমিষ্ট আজানের মাধ্যমে ইসলামের বার্তা ছড়িয়ে পড়ার কথা বলা হয়েছে, যা মুসলমানদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। নজরুল তার ‘মহরম’ কবিতায়ও কারবালার শাহাদাতের মাধ্যমে আত্মত্যাগের মহিমা তুলে ধরেছেন, যা বর্ণিত বীরদের ত্যাগের আদর্শকেই সমর্থন করে।

ঐক্য, শান্তি ও নতুন সমাজ

আজান কেবল নামাজের আহ্বান নয়, বরং এটি মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রেরণা জোগায়। নজরুল আজানের সুরকে কখনো বিদ্রোহের প্রতীক হিসাবে, কখনো শান্তির বার্তা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তিনি আজানের মাধ্যমে একটি নতুন সমাজ ও আধ্যাত্মিক জাগরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

তার বিখ্যাত নাশিদ ‘আল্লাহু আকবর! আল্লাহু আকবর!’ সরাসরি আজানের বাণী দিয়ে শুরু হয়েছে, যা তার গভীর ইসলামি চেতনার পরিচায়ক। ‘ফজরের আজান শুনিতে যে দিল জাগে’ গানে তিনি আজানের সুরের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জাগরণের কথা বলেছেন। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, যারা আজানের ধ্বনি শুনে জাগ্রত হয়, তারাই সত্যিকারের মুসলিম, যারা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে। একইভাবে, ‘সকালে হে শুনলে আজান’ গানেও তিনি ভোরের আজানের মাধ্যমে একটি নতুন দিনের সূচনা এবং আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মোচনকে তুলে ধরেছেন, যা তার আজান-ভাবনারই আরেকটি দিক।

সুতরাং কাজী নজরুল ইসলাম তার আজান-ভাবনার মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে কেবল ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি মনোযোগী হতে বলেননি, বরং তাদের অজ্ঞানতার ঘুম থেকে জেগে উঠে আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করতে, আল্লাহর একত্ববাদে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে, আত্মত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক নতুন, উন্নত সমাজ ও গৌরবময় ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে উৎসাহিত করেছেন।

লেখক : সভাপতি, আলীকদম প্রেস ক্লাব, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম