Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ধর্মীয় বিষয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়

Icon

মাহমিয়া আলম শান্তা

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ধর্মীয় বিষয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়

প্রযুক্তির আশীর্বাদ যে কতখানি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে, তা যেমন অস্বীকার করার নয়, তেমনি এ প্রযুক্তিরই অপব্যবহার বা অপবিন্যাস যখন ইমানি বিষয়গুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটায়, তখন তা আর নিছক প্রযুক্তি থাকে না; পরিণত হয় এক চুপিসারে ঘিরে ফেলা ফিতনায়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন আর কোনো কল্পবিজ্ঞানের বিষয় নয়। এটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অঙ্গ, কখনো মোবাইল অ্যাপে, খবরে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, আবার কখনো আমাদের পড়াশোনার টেবিলেও। প্রাথমিকভাবে মানুষ এটি গ্রহণ করেছে একটি স্মার্ট প্রযুক্তি হিসাবে যা কাজের গতি বাড়ায়, বিশ্লেষণে সহায়তা করে এবং প্রশ্নের উত্তর মুহূর্তেই হাজির করতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞানের মতো সূক্ষ্ম, দ্বীননির্ভর ও আমানতপূর্ণ বিষয়ে যখন এ প্রযুক্তি আধিপত্য বিস্তার করে, তখন প্রশ্ন জাগে আমরা কি ভুল পথে হাঁটছি?

আমাদের সমাজে একটি গভীর পরিবর্তন ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। নতুন প্রজন্মের বড় একটি অংশ আজ আলেমদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইমানি জিজ্ঞাসা, শরিয়াহ সংক্রান্ত তথ্য, এমনকি ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান সম্পর্কেও তারা আলেম বা বিশ্বস্ত ইসলামি গ্রন্থ না দেখে সরাসরি ভরসা করছে এআইভিত্তিক চ্যাটবট বা সার্চ ইঞ্জিনের ওপর। এটা নিছক সময় বাঁচানর কৌশল নয়, বরং এক ধরনের গভীর দাওয়াতি ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।

যেমন-২০২৪ সালে বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওপেন এআইয়ের চ্যাটজিপিটি মাঝে মাঝে ধর্মীয় বিষয়ে ভুল তথ্য প্রদান করে। এ ভুল তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশের আলেমরা সতর্কতা জারি করে সহিহ উৎস থেকে তথ্য গ্রহণের পরামর্শ দেন। এ ধরনের ঘটনা দেখিয়ে দেয়, এআই যদি একটি মৌলিক ইসলামি বিধান নিয়ে এমন ভুল করে এবং সেটি যদি অসচেতন ব্যবহারকারীদের কাছে ‘বুদ্ধিমত্তার ফতোয়া’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়, তবে সমাজে কী ধরনের ধর্মীয় বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

এআইয়ের অন্যতম সমস্যার একটি হলো এর ‘ব্ল্যাক বক্স’ প্রকৃতি। অর্থাৎ একটি এআই মডেল কীভাবে, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাল সেই প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই বোধগম্য নয়। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ ২০২৪-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এআইয়ের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, যাকে ‘ব্ল্যাক বক্স’ বলা হয়, এখনো গবেষকদের কাছে পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানের এ অস্বচ্ছতা বড় ধরনের বিপদ। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘জিজ্ঞাসা করো জ্ঞানীদের, যদি তোমরা না জানো’। (সূরা নাহল, ১৬:৪৩।) কিন্তু এআই তো কোনো আলেম নয়, বরং এটি একটি প্রোগ্রাম, যার পেছনে কাজ করে হাজারো লাইন কোড, বহু ধরনের উৎস, যার মধ্যে সহিহ-ভুল, সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ। এমন এক অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার কাছ থেকে ইসলামি জ্ঞানের আশা কি গ্রহণযোগ্য?

আলেমদের থেকে নয়, বরং যান্ত্রিক প্রোগ্রামের কাছ থেকে যখন কেউ দ্বীনের জ্ঞান নিতে চায়, তখন সে ‘ইলম’-এর বদলে কেবল ‘তথ্য’ নিচ্ছে যার ভেতরে নেই খুশু, নেই তাকওয়া, নেই আমানত। এমন এক যান্ত্রিক ফতোয়ার সংস্কৃতি যদি বিস্তার লাভ করে, তবে একদিন ইসলাম আমাদের মাঝেই থাকবে, কিন্তু এর ব্যাখ্যা থাকবে কোডের ভেতর আত্মা ও আদর্শহীন।

ইসলাম কোনো প্রযুক্তির বিরোধিতা করে না। বরং যে প্রযুক্তি ইমান, জ্ঞান ও দাওয়াহর খেদমতে ব্যবহৃত হয়, ইসলাম তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু প্রযুক্তি যদি নিজেই ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেটিকে সীমার মধ্যে রাখাই ফরজ। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন যা কিছু পৃথিবীতে আছে’। (সূরা বাকারা, ২:২৯)। অর্থাৎ সৃষ্ট জগৎ ব্যবহারের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু নৈতিকতা ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে?

এআই এ যুগের এক অভূতপূর্ব পরীক্ষা। এটি যেমন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে, তেমনি এটি বিভ্রান্তির দ্বার খুলে দিতে পারে। ইসলামি জ্ঞানের মতো স্পর্শকাতর বিষয় যদি একটি অস্বচ্ছ, কখনো মিথ্যাবাদী, কখনো বিভ্রান্তিকর অ্যালগরিদমের ওপর নির্ভর করে, তবে আমরা এক চরম ফিতনার মধ্যে পা রাখছি। এ ফিতনা শুধু প্রযুক্তির নয়, বরং আত্মার, বিশ্বাসের এবং আমানতের। আমরা যেন কেবল প্রযুক্তির গতি নিয়ে না মেতে উঠি, বরং আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের মধ্য দিয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জনের পথ খুঁজি।

লেখক : শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম